ঢাকা: কোটি বাঙালিকে একত্রে হাসায়-কাঁদায় ক্রিকেট। নির্বিশেষে উজ্জীবিত করে আপন মহিমায়।
উনিশ মার্চ, পুরো দেশ যখন তাকিয়ে বিশ্বমঞ্চে উপবিষ্ট ১১ তরুণের দিকে- তখনই এলো ছন্দপতনের ধ্বনি। বিভীষিকাময় এক তথ্য, নিষিদ্ধ ‘গতিদানব’ ও ‘ঘূর্ণি জাদুকর’। সহসা আর উঠবে না গতির ঝড়; আর দেবে না ঘূর্ণিপাক!
পুরো ঘটনাটিকে (নিষিদ্ধের বিষয়) স্রেফ ‘ষড়যন্ত্র বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে দেখছেন সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী জনতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনরা। অনেকের মতে, বিশ্বকাপের মাঝ পর্যায়ে দু’জন ক্রিকেটারকে অভিযুক্ত করে বাদ দেওয়া হয়তো পূর্ব পরিকল্পিত। কেননা এতো বড় একটি আয়োজনে অন্য আর কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলো না- শুধু বাংলাদেশের দুই বোলারকেই চোখে পড়লো! তার মানে কি পৃথিবীর আরও সব দলের খেলোয়াড় শুদ্ধ আর বাংলাদেশেই অশুদ্ধ!
টিম বাংলাদেশ মাঠে এর জবাব দেবে। দেশ থেকে সঙ্গী হয়েও মাঝ পথে দলে নেই তাসকিন আহমেদ ও আরাফাত সানি, তবে কোটি বাঙালি তো আছেন। কোটি বাঙালির স্বপ্ন বুননে ষড়যন্ত্রের পাল্টা জবাব আসবে বাকি ক্রিকেটারদের কাছ থেকে।
খোদ টি-টোয়েন্টি দলে থাকা মুশফিকুর রহিম এ বিষয়ে বলেছেন, বিশ্বাস আছে তাসকিন ও সানি শিগগিরি পুনর্বাসন শেষ করে দলে ফিরে আসবে। বাংলাদেশ দল ও দেশবাসী সবাই তাদের সঙ্গেই রয়েছে।
কতশত কাজ-রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব-মন্ত্রিত্ব, তারপরও সময় করে খেলা দেখেন, খবরা-খবর রাখেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা সম্বন্ধে প্রতিবাদী ভাষায় লিখেছেন, সানি-তাসকিন তাড়াতাড়ি চলে আসো। এক মাসের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে ফেলো। তারপর বেরিয়ে পড়ো আবার শিকারে। জাতিকে বেশি দিন ক্ষুধার্ত রাখা তোমাদের ঠিক হবে না।
এক সময়ের ক্রীড়া প্রতিবেদক, বর্তমানে সাংবাদিকতার শিক্ষক-গবেষক মাহবুবুল হক ওসমানী বাংলানিউজকে বলেছেন, দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ করে গত ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের উন্নতি ছিল ঈর্ষা করার মতো। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে যখন গত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেছিলো টিম বাংলাদেশ, তখনই বিশ্বের তামাম ক্রিকেটবোদ্ধাদের চোখ কপালে উঠলো! কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা হলো ভারতের সঙ্গে। কিন্তু সে খেলায় ভারত পেশাদারী ক্রিকেট না খেলে যেন দেখাতে চাইলো পেশিশক্তি। জেন্টলম্যান গেমসকে তারা বানালো পাওয়ার গেমস! হারলো বাংলাদেশ।
পরিসংখ্যান টেনে তিনি বলেন, এরপর ঘরের মাঠে বাংলাদেশ টানা পাঁচটি সিরিজ জিতলো জিম্বাবুয়ে (দুইবার), পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে ক্রিকেটের মোড়ল দেশগুলো তখন বাংলাদেশের এই তরুণদের কাছে একে একে নাকানিচুবানিতে খাচ্ছে। যার রেশ ধরে মোড়লরা মেতে উঠলো নতুন ষড়যন্ত্রে।
ওসমানী আরও বলেন, এর আগে আব্দুর রাজ্জাক, সোহাগ গাজী, আল-আমিন হোসেনের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল-আইসিসি। কিন্তু এবার যেন খুব তাড়া আইসিসির! বিশ্বকাপ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আরাফাত সানি আর তাসকিনের বোলিংকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো তারা। আর তড়িঘড়ি করে নিষিদ্ধের রায়টাও শুনিয়ে দিলো। বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরার অন্যতম এক প্লাটফর্ম এই ক্রিকেট। এ দেশের ক্রিকেটকে হেয় করার জন্য এটি আইসিসির সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। গত বিশ্বকাপের মতো এবার এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যেন তাদের শক্তিমত্তা দেখাতে না পারে, যেন তাদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে সেজন্য আইসিসির এই চক্রান্ত। আর আইসিসির এই সিদ্ধান্তের পেছনে ক্রীড়ানক হিসেবে সত্যিকার অর্থে কাজ করেছে ক্রিকেটে মোড়ল দাবিদার দেশগুলো।
এদিকে আরাফাত সানির বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি সন্দিহান থাকলেও, দুশ্চিন্তা ছিলো না তাসিকন আহমেদকে ঘিরে। কিন্তু তাসকিনকেও নিষিদ্ধ করা হলো। তাই তো গতিদানব তাসকিনের ওপর ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির নিষেধাজ্ঞাকে এক কথায় ‘প্রহসন-অবিচার’ বলেছেন বোলিং অ্যাকশন ইস্যুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আইনজীবী হিসেবে কাজ করা মুস্তাফিজুর রহমান খান।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গী খালেদ মাহমুদ সুজনও বিস্মিত হয়েছেন তাসকিন নিষিদ্ধ হওয়াতে। তিনি বলেছেন, সানি-তাসকিনের যে কষ্ট-কান্না তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়!
ক্রিকেট ভক্ত রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করে বলেন, আমি যতটা বুঝি সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র এটি। ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা। এর বিরুদ্ধে আমরা কুলিয়ে উঠতে না পারলে ভবিষ্যতের জন্য আরও অশনি সংবাদ অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উচিৎ সাময়িক নিষিদ্ধের কারণ সংযুক্ত একটি ব্যাখ্যা আইসিসির কাছে চাওয়া- আর কেনই বা বিশ্বকাপে এমন অভিযোগ তোলা হলো তা স্পষ্ট করে জানতে চাওয়া। কারণ এই দুই ক্রিকেটার তো গত টানা নয় মাস ধরেই দলে নিয়মিত।
সাংবাদিক আরাফাত সিদ্দিক বলেন, অর্জুনা রানাতুঙ্গার কথা মনে পড়ছে, কী কারণে যেন তিনি সব প্লেয়ারকে নিয়ে খেলা চলাকালে মাঠ থেকে চলে এসেছিলেন!
মূলত ‘১৯ মার্চ’ তারিখটিই যেন বিতকির্ত এদেশের ক্রিকেটের জন্য। গত বছর ১৯ মার্চেই মেলবোর্নে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আউট হওয়া বলে জোর করে নো-বল ডাকা হয়েছিলো।
এদিকে বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে আরাফাত সানির সঙ্গে তাসকিনের অ্যাকশন নিয়েও সন্দেহ তোলেন আম্পায়াররা। পরে গত ১২ মার্চ স্পিন কোচ রুয়ান কালপাগের সঙ্গে সানি ও ১৫ মার্চ পেস বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিকের সঙ্গে তাসকিন চেন্নাইয়ে গিয়ে বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দেন। শনিবার (১৯ মার্চ) সেগুলোরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসে। যাতে বোলিং অ্যাকশন অবৈধ প্রমাণিত হওয়ায় বাংলাদেশ দলের এই দুই বোলারের জন্যই শেষ হয়ে গেলো এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অ্যাকশন শুদ্ধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বোলিং করতে পারবেন না তারা। ফলে আসর ছেড়ে চলে আসতে হচ্ছে দেশে।
এখন নেই গতির তাসকিন কিংবা দলের একমাত্র বিশেষজ্ঞ স্পিনার সানি, তবে তাদের প্রতি আছে কোটি বাঙালির ভালোবাসা। আর বাকি সদস্যদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন। বিতর্কের সম্মুখ জবাব দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণাগুলো নিয়ে সোমবারের (২১ মার্চ) অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের জন্য প্রস্তুত কোটি বাঙালি। ওদিকে সতীর্থ হারিয়ে আহত বাঘের মতো থাকা টিম বাংলাদেশও জবাব দিতে মুখিয়ে রয়েছে। জবাব দেওয়া হবে ২২ গজের ওই পিচেই...।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৬
আইএ/এটি