ঢাকা: বিধি অনুযায়ী, বোলারের যে নির্দিষ্ট ডেলিভারি সন্দেহজনক মনে হয়েছে, সেই ডেলিভারির ব্যাপারেই সুনির্দিষ্ট করে অফিসিয়ালদের রিপোর্ট করার কথা। হয়নি তা।
বোলার যে তিন ধরনের ডেলিভারি দিয়ে থাকেন, তার মধ্যে স্টক ও ইয়র্কারে কোনো ত্রুটি ধরা পড়লো না। ত্রুটি ধরা পড়লো অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যে বাধ্য হয়ে ছোঁড়া ৯টি বাউন্সারের ৩টিতে, যে ৩টির গতি আবার অন্য ৬টির চেয়ে অনেক কম ছিল। বিস্ময়করভাবে এই ৩টির ত্রুটিকেই ধরা হলো ভিত্তি।
এমন বিতর্কিতভাবে ওই ৩টিকে ভিত্তি ধরা হলেও বিধি অনুযায়ীই সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারির কথা নয়, সর্বোচ্চ সতর্ক করে দেওয়ার কথা এই বলে যে, ‘তুমি এ ধরনের বল করা থেকে বিরত থাকবে। যদি আবার ছোঁড়ো, তবে দ্বিতীয়বার রিপোর্টেড হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারো। ’
হলো না তা-ও। নিজেদের বিধি লঙ্ঘন করেই জারি হলো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা। আরও বিস্ময়কর, হাস্যকর ও তামাশার ব্যাপার, যেই ডেলিভারিতে অভিযুক্ত করে বোলারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, রিপোর্টের ম্যাচে সেই ডেলিভারিই দেননি ‘বলি’ হওয়া বোলার।
এমন ‘তামাশা’র শিকার হয়ে ‘বলি হওয়া’ বোলারের নাম তাসকিন আহমেদ। ক্রিকেটের এই সময়ের পেসারদের মধ্যে প্রধান সারির ‘গতিদানব’। আর এই ‘তামাশার নাটক’ মঞ্চস্থ করায় অভিযুক্ত খোদ ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। আইসির পেছনের কলকাঠির পরিচালক হিসেবে নাম আসছে ক্রিকেটের একটি মোড়ল দেশের।
নিজেদের বিধি নিজেরা লঙ্ঘন করে তাসকিন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে আইসিসির ষড়যন্ত্রের ‘থলের বিড়াল’ বেরিয়ে পড়েছে বলে তুমুল সমালোচনা চলছে পুরো ক্রিকেটবিশ্বে। সমালোচনার ঝড় বইছে ফেসবুক-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে ক্রিকেটের অভিযুক্ত মোড়ল রাষ্ট্রটিও।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো আসরের মাঝপথে শনিবার (১৯ মার্চ) প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আরাফাত সানি ও তাসকিন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা জানায় আইসিসি। সানির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়, ‘তার কনুই বল ছোঁড়ার সময় সীমা লঙ্ঘন করে’। কিন্তু তাসকিন আহমেদের ব্যাপারে একেবারেই অস্পষ্ট করে বলা হয়, ‘তার সব ডেলিভারি বৈধ নয়’।
এ নিয়ে সন্ধ্যায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করেন বোলিং অ্যাকশন ইস্যুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আইনজীবী হয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান। তিনি আইসিসির ধারা, তাসকিনের পরীক্ষার প্রক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপের বিস্তারিত তুলে ধরেন তার একটি ফেসবুক পোস্টে। সেখানে এ আইনজীবী বলেন, ফাইজলামির একটা সীমা আছে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রহসন। তাসকিন অবিচারের শিকার হয়েছেন।
মুস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, আইন অনুসরণ করলে তাসকিন আহমেদকে সর্বোচ্চ সতর্ক করা যায় নির্দিষ্ট ডেলিভারিটির ক্ষেত্রে, কিন্তু নিষিদ্ধ করার সুযোগ নেই। তারপরও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আইসিসি তাদের তৈরি করা নিয়ম নিজেরাই ভেঙেছে।
যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, বোলিং অ্যাকশন সম্পর্কিত আইসিসির আইনের ২.২.৬ ধারায় বলা আছে, যে ডেলিভারির জন্য আম্পায়াররা বোলারকে সন্দেহ করেছেন, ল্যাব পরীক্ষায় সেই নির্দিষ্ট ডেলিভারিই করে দেখাবেন বোলার। কিন্তু অফিসিয়ালরা তাসকিনকে নির্দিষ্ট কোনো ডেলিভারির জন্য অভিযুক্ত করেননি। কেবল বলেছেন, ‘তার অ্যাকশন সন্দেহজনক’। আম্পায়ারদের অভিযোগটাই ভুল।
তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী পরীক্ষা হওয়ার পরও তাসকিন যে ধরনের বল করে থাকেন তার মধ্যে স্টক ও ইয়র্কারের অ্যাকশনে কোনো ঝামেলা হয়নি। অ্যাকশনে ত্রুটি ধরা পড়েছে কেবল তার বাউন্সারে। হিমাচলের ধর্মশালার বৈরী পরিবেশে টানা তিন ম্যাচ খেলে ক্লান্ত হয়ে আইসিসির ল্যাবে যাওয়ার পর হিমাচলে টানা তিন ম্যাচ খেলে ক্লান্ত তাসকিনকে মাত্র ৩ মিনিটে অবিশ্বাস্যভাবে ৯টি বাউন্সার করানো হয়েছে। এরমধ্যে ৬টি বাউন্সারেরই অ্যাকশন বৈধ ছিল। ত্রুটি ছিল ৩টির, যে ৩টির গতি আবার বেশ কম ছিল অন্য ৬টির তুলনায়। অথচ এই ৩টির ভিত্তিতেই তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো।
মজার ব্যাপার হলো, যে ম্যাচে তাসকিনের অ্যাকশন নিয়ে আইসিসির অফিসিয়ালরা সন্দেহ প্রকাশ করেন, সে ম্যাচে তিনি কোনো বাউন্সারই দেননি। যদিও আইসিসির ২.২.৬ ধারাতেই বলা আছে, ‘যে ম্যাচে সন্দেহে পড়বেন সেই ম্যাচের করা নির্দিষ্ট ডেলিভারির বাইরে অন্য কোনো ডেলিভারি এই পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত নয়’।
মুস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, বোলিং অ্যাকশন নিয়ে মাঠের দুই আম্পায়ারের সন্দেহ প্রকাশ থেকে শুরু করে ল্যাব পরীক্ষার পর নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তেই আইসিসি নিজেদের নিয়ম নিজেরা অনুসরণ করেনি।
বিসিবির এ আইনজীবী স্পষ্ট করে বলেন, তাসকিন অবিচারের শিকার। আমি বিসিবিকে ধারাগুলো নির্দিষ্ট করে এর আওতায় সংশ্লিষ্ট কোর্টে আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছি।
মুস্তাফিজুর রহমান খানের ফেসবুক পোস্টটি ছড়িয়ে পড়তেই আইসিসিবিরোধী বিতর্কের আগুনে যেন ঘি পড়ে যায়। প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষার প্রক্রিয়া নিয়ে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সমালোচনার শূলে চড়াচ্ছেন টাইগার ক্রিকেটপ্রেমীরা। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষা প্রক্রিয়াই আইসিসির নির্লজ্জ ষড়যন্ত্রের ‘থলের বিড়াল’ বের করে দিয়েছে। আর এই ষড়যন্ত্রের পেছনে ক্রিকেটের একটি মোড়ল রাষ্ট্রকেও সরাসরি দায়ী করছেন তারা।
খোদ টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও তাসকিনের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে মানতে পারছেন না। তিনি রোববার (২০ মার্চ) বেঙ্গালুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে কেঁদেই ফেলেন। বলেন, ‘তাসকিনের বোলিং অ্যাকশনে কোনো ত্রুটি ছিল না। তারপরও কেন তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে? এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, তাসকিনের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। ’ এজন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম কামাল তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘প্রিয় বিসিবি, ‘আইছিছি’র সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুইজারল্যান্ডের লুজানে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে যান। যা করার দ্রুত করুন। গোটা বাংলাদেশ আপনাদের সাথে থাকবে। আপনারা যদি লড়তে পারেন, তবে ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। ‘আইছিছি’কে ‘আইসিসি’ বানাতে পারবেন। ’
সাহিত্যিক এম এম ওবায়দুর রহমান তার ফেসবুকে বলেন, ‘যতদিন না আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের কণ্ঠ, বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারবো, ততদিন আমাদের ওপর এরকম জুলুম আর অবিচার হতেই থাকবে। আমি গতকাল একটি ভিডিও শেয়ার করেছি। যেখানে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার মুরালিধরনের বল অবৈধ রায় দেবার পরে সাহসী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা তার প্রতিবাদ করে খেলা ছেড়ে উঠে যান। আম্পায়ার আর ম্যাচ রেফারি পরবর্তীতে ভুল স্বীকার করেন এবং মুরালি বল করতে সুযোগ পান। ন্যায়ের জন্য প্রতিবাদ করতে হলে আপনাকে সাহসী হতে হবে। ’
আইসিসির এ নিষেধাজ্ঞা হাস্যকর ও নিন্দনীয় অভিহিত করে লেখক ফরিদুল ইসলাম নির্জন তার ফেসবুকে বলেন, ‘এখন বিশ্বজুড়ে কনে পক্ষের লোক আইসিসির চাকরির কথা শুনলে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। ’
মনির হোসেন মনির নামে এক ক্রিকেটপ্রেমী স্পষ্ট করে বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ভারতীয় গভীর চক্রান্তের অবৈধ নীলনকশা। ’
ক্রিকেটপ্রেমী আরিফুর রহমানের মতে, এই নিষেধাজ্ঞা পাড়ার খেলার মতো। অমুক অমুক ভালো খেলোয়াড় প্রতিপক্ষে খেলতে পারবেন না। তারা খেললে দুই দলের শক্তি সমান থাকবে না। আবার এমনও, মাঠে ফিল্ডার বসে থাকার ভিত্তিহীন অজুহাতে বড় ভাই আম্পায়ারের নো কল করা। আইসিসি একটি ক্রিকেটের মোড়ল রাষ্ট্রের দালাল হয়ে কাজ করছে। যে রাষ্ট্রের গণমাধ্যমে এখন তাসকিনের রক্তাক্ত মুণ্ডু ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরিফুর বলেন, এই প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষা ও তার ফলাফল পরবর্তী পদক্ষেপের মাধ্যমে আসলে আইসিসি যে নির্লজ্জ ষড়যন্ত্র করেছে, সেটাই থলে থেকে বিড়াল হয়ে বেরিয়ে গেল।
এ বিষয়ে প্রায় সব ক্রিকেটপ্রেমীই বিসিবিকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও বেশি ভুগতে হবে বলে সতর্ক করেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৬
এইচএ/