ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

বাবার স্বপ্নেই এগিয়ে যাচ্ছেন শুকতারা

মেহেরিনা কামাল মুন, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৮
বাবার স্বপ্নেই এগিয়ে যাচ্ছেন শুকতারা আয়শা রহমান শুকতারা। ছবি: শোয়েব মিথুন

গতানুগতিকতার বাইরে যাদের জীবন যাপন তারাই হন সফল। তারাই হন উদাহরণযোগ্য। যেখানে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারীকে প্রতিনিয়ত, প্রতি পদে বাধা পেতে হয়, সেখানে কোনো নারী যখন পুরুষদের সমান কিছু করে দেখানোর সাহস ও উৎসাহটা নিজের পরিবার থেকে পেয়ে যান, তখন তার জন্য কোনো কিছুই জয় করা অসম্ভব নয়।

এমনই এক নারী, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য আয়শা রহমান শুকতারা। স্কুল জীবন থেকেই ভলিবল-হ্যান্ডবলে ছিলেন পারদর্শী।

স্কুলেরই এক শিক্ষিকা পরামর্শ দিলেন ক্রিকেটে আসার। শুকতারার পরিবারকেও রাজি করিয়ে ফেলেন। বাবারও স্বপ্ন ছিল, যদি বাংলাদেশে কখনো নারী ক্রিকেট দল হয়, তার মেয়ে সেখানে খেলবে। বাবার স্বপ্নের পথেই পা বাড়িয়ে দিল মেয়ে শুকতারা। শুরু হলো ক্রিকেটের পানে ছুটে চলা।

ভাগ্য এতটাই পক্ষে ছিল, কিছুদিনের মধ্যেই খুলনা বিভাগে নারী ক্রিকেটার হান্ট শুরু হলো। শুকতারার থেকে যেনো তার বাবাই বেশি রোমাঞ্চিত এই খবরে। ফুটবলার বাবার মেয়ে ক্রিকেটার হবেন, এই স্বপ্ন তিনি সফল হতে দেখছিলেন খোলা চোখেই। নিজেই মেয়েকে নিয়ে গেলেন বাচাই পর্বের জন্য। বাছাই পর্ব পার হয়ে গেলেন খুব সহজেই। জাতীয় দলের পথটাই গেল সহজ হয়ে।

বাছাই পর্ব পার হওয়ার পর একটি ওপেন টুর্নামেন্টে অংশ নিলেন শুকতারা। এরপরই এলো জাতীয় দলে খেলার সুযোগ। ভালোবাসা থেকে যে ক্রিকেটের শুরু সেটিই হয়ে গেলো শুকতারার পেশা। অন্য কিছু করার আর চিন্তাই আসেনি মাথায়। হয়ে উঠলেন পুরো দস্তুর ক্রিকেটার। ডানহাতি ব্যাটসম্যান শুকতারার ক্রিকেটের শুরু গল্পটা এভাবেই জানা গেলো তার কাছ থেকে।

শুকতারাবাংলাদেশের খুলনা বিভাগকে অনেকেই ক্রিকেটের ‘আঁতুড়ঘর’ বলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বেশি ক্রিকেটার উঠে আসেন এই বিভাগ থেকে। বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে এই খুলনা বিভাগের ক্রিকেটারদের শক্তিতে। মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান থেকে শুরু করে তরুণ মোস্তাফিজুর রহমান, মেহেদি হাসান মিরাজের মতো ক্রিকেটার উঠে এসেছে ক্রিকেটের পুণ্যভূমি খুলনা থেকে। এমন জায়গায় জন্ম নিয়ে শুকতারা যেনো এক ধাপ আগেই পার হয়ে ছিলেন। সামাজিক বাধা না থাকায় নিজেকে মেলে ধরতে সময় লাগেনি মোটেই।

২০০৭ সালে জাতীয় দলের হয়ে শুরু করলেও পথ যেনো সামনে আগাচ্ছিলো না। খেলছেন ঠিকই কিন্তু বের হতে পারছে না হারের বৃত্ত থেকে। নেই নারী ক্রিকেট নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা, নেই তেমন কোনো পরিকল্পনা। তবু দলের প্রতিটি সদস্যের মতোই হাল ছাড়েননি শুকতারাও। সবার মনেপ্রাণে বিশ্বাস ছিল, একদিন নারী ক্রিকেট দল এমন কিছু করে দেখাবে যেখান থেকে শুধুই আলোই ছড়াবে, অন্ধকার আর ছুঁতে পারবে না তাদের।

সেই বিশ্বাস নিয়ে পথ চলার ফসল হিসেবেই যেনো পেয়েছেন এশিয়া কাপের শিরোপা, আয়ারল্যান্ড সিরিজ জয়, বিশ্বকাপ বাছাইয়ের সেরা দলের টাইটেল। শুকতারা অন্তত এটাই মনে করেন, দলের প্রতিটি সদস্যের অখন্ড বিশ্বাস, একাগ্রতা ও পরিশ্রমই আজকের নারী দলের সাফল্যের মূলমন্ত্র।

দলের খারাপ সময়ে যেমন ছিলেন দেখছেন ভালো সময়টাও। নিজের জায়গা নড়বড়ে হওয়াটাও দেখেছেন। ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে বাদ পড়েন দল থেকে। সে বছর জায়গা হয়নি বিশ্বকাপ বাছাই পর্বেও। নিজেকে বুঝিয়েছেন। শক্ত থেকেছেন। পরিশ্রম করেছেন। আবারও ফিরেছেন দলে। দেখিয়েছেন নিজের দক্ষতা মারকুটে এই ব্যাটসম্যান।

শুরু থেকে এ পর্যন্ত পাল্টে গেছে অনেক কিছু। দল ও ক্রিকেটারদের উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নারী ক্রিকেট দলের প্রতি চিন্তাধারারও এসেছে পরিবর্তন। বেড়েছে সুযোগ সুবিধা। তবে সুযোগ সুবিধা কিছুটা কম থাকলেও কখনোই ভাবেননি ক্রিকেট ছাড়ার কথা। শুধুই ভেবেছেন পুরুষ ক্রিকেট দলও শুরুর দিকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত থেকেছেন, এখন তারা সফল। নারীও একদিন ঠিকই এগিয়ে যাবে সকল অভাব নিয়েও। আর এই মানসিকতাই সফলতা এনেছে একের পর এক।

দেশের ও দেশের বাইরের প্রিয় ক্রিকেটারের নাম জানতে চাইলে যেনো একটু দ্বন্দেই পরে যান শুকতারা। একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলেন, ‘আসলে ফলো তেমন কাউকে করা হয় না তবে দেশের মধ্যে তামিম (ইকবাল) ভাইয়ের খেলা ভালো লাগে। দেশের বাইরে শচীন টেন্ডুলকার ও রিকি পন্টিং। দল হিসেবে তেমন কোনো দেশ প্রিয় নেই। আমি আসলে সব দেশের সব ধরনের ক্রিকেট দেখি। সেখান থেকেই অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করি। ’

মারকুটে ব্যাটসম্যান। দারুণ একজন ফিল্ডার। আর একজন নারী। ঈদ কোথায় করবেন, পরিকল্পনা কী? জানতে চাইলেই হাসি নিয়ে বললেন, ‘এমনিতে তো শ্বশুর বাড়িতে ঈদ করা হয়। গেলো ৩-৪ বছর সেখানেই ঈদ করি। এবার বাবার বাড়ি যাবো। ’ জানালেন  অনুশীলন শেষ করেই বাবার বাড়িতে চলে যাবেন।

ক্রিকেটার শুকতারার স্বামীও জড়িয়ে আছেন ক্রিকেটেই। বাংলাদেশ এ দলের ট্রেনার ইফতেখারুল ইসলাম। দু’জন মানুষ ক্রিকেট নিয়ে এতটাই ব্যস্ত সময় কাটান যে নিজেদের দেওয়ার মতো সময়টা পান না। তাই ভবিষ্যতে নিজেদের সময় দিতে চান শুকতারা। পরিবারকে যেনো ভুলতেই বসেছেন। তাই ক্যারিয়ার শেষে নিজের জীবনটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে চান।

সে অনেক পরের কথা। বর্তমান চিন্তাটা শুধু ক্রিকেট নিয়েই। কিভাবে নারী ক্রিকেটকে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, পরিকল্পনাটাও জানালেন। রুট লেভেলের ক্রিকেটার বাছাই করার বিকল্প দেখেন না শুকতারা। পাশাপাশি নারীদের প্রিমিয়ার লিগ, জেলা পর্যায়ে লিগ থেকেই আসতে পারে নতুন নতুন নারী ক্রিকেটার। জাতীয় দলের বাইরেও অনেক ক্রিকেটাররা অনুশীলন করেন, তাদেরকেও সঠিক সুযোগ দেওয়ার কথাই জানালেন এই নারী ক্রিকেটার।

সাদা পোশাকে নিজেদের ক্রিকেটের সবচেয়ে সম্মানিত ফরম্যাটে দেখার সুযোগও পেয়ে যেতে পারেন নারীরা। সেই সুযোগ এনে দেওয়ার কাজও শুরু করে দিয়েছে বিসিবি। কিন্তু সেটা যখন হবে তখন। বর্তমানটা শুধুই বিশ্বকাপের পরিকল্পনায় কাটাচ্ছেন শুকতারা সহ দলের প্রতিটি সদস্য। নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভালো কিছু নারী দলকে আরও উচ্চতায় উঠিয়ে দেবে। র‍্যাংকিংয়ের আটে আসার লক্ষ্য নিয়েই বিশ্বকাপে পা রাখার পরিকল্পনা শুকতারাদের।

ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আগে এমন একটি সিরিজের স্বপ্ন দেখেন শুকতারা যা তাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকের মনে বাঁচিয়ে রাখবে অনেক অনেক দিন। নিজেকে নারী ক্রিকেটারদের ব্যাটসম্যানদের এক নম্বরে দেখার স্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন এই মারকুটে ব্যাটসম্যান।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট, ২০১৮
এমকেএম/এমএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।