১৯৮৮ সালের ৫ নভেম্বর। প্রেম কোহলি-সরোজ কোহলি দম্পতির ঘর আলো করে এসেছিল তৃতীয় সন্তান বিরাট কোহলি।
কোহলির জার্সি নম্বরটা ১৮। জাতীয় দলে হোক, কিংবা আইপিএলে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু-সব জায়গাতেই হালের সেরা এই ব্যাটসম্যানের জার্সির পেছনে শোভা পায় ‘১৮’ সংখ্যাটা। কোহলির জার্সি তো শচীনের মতো ১০-ও হতে পারত! নেহাত শখের বশে নয় কিংবা সংখ্যাটা কোহলির প্রিয় বলেও নয়। ‘১৮’-র সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার জীবনের, ক্রিকেটে আসার অনুপ্রেরণার একটা গল্প। তারিখটা ছিল ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৬। যেদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তার বাবা প্রেম কোহলি, তখনো জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়নি কোহলির। বাবা মারা যাওয়ার পর দিল্লির হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলে এসে বাবার সৎকার করেছিলেন ১৮ বছরের সাহসী কোহলি। ক্রিকেটের মাঠে তাকে ছেড়ে দেওয়াটা শিখিয়েছিলেন বাবা প্রেম কোহলি। বাবাই ছিলেন তার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনের কারিগর। বাবার মৃত্যুতে মানসিকভাবে বেশ বড় ধাক্কা লাগে কোহলির জীবনে। বাবার স্বপ্ন পূরণে কোহলি সেই দিনটির তারিখ বেছে নেন নিজের জার্সিতে। তখন তার বয়সটাও ছিল ১৮।
এরপরই শুরু হয়েছিল কোহলির স্বপ্নযাত্রা। বাবার মৃত্যুর দুই বছর পর ২০০৮ সালে ভারতীয় দলের জার্সি পরেন কোহলি। ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক হয়ে ২০০৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতেন তিনি। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। মাঠে বাবাকে পাশে পেতে ‘১৮’ জার্সিটাকে পিঠে ঠিকই বয়ে নিয়ে চলছেন ভারতীয় এই তারকা ব্যাটসম্যান। ২০১৪ সালে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের মাঝে মহেন্দ্র সিং ধোনির টেস্ট অবসরে ভারতীয় টেস্ট দলের নেতৃত্বের ব্যাটনটা ওঠে বিরাটের হাতে। দুই বছর পর ধোনি ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের নেতৃত্ব ছাড়ার পর বিরাটের হাতে ওঠে টিম ইন্ডিয়ার নেতৃত্ব।
কোহলি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, কলকাতার মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১১ লাখ ২ হাজার ৯২১ জন পরীক্ষার্থীর প্রশ্নে কোহলির জীবনী লেখা ছিল বাধ্যতামূলক। প্রশ্নের মান ছিল ১০। খুব ছোট বয়স থেকেই ক্রিকেটের প্রতি প্রচণ্ড নেশা ছিল কোহলির। সেই নেশা এতটাই বেশি ছিল যে, অন্য কোনো দিকে তার হুঁশ ছিল না। ছোটোবেলায় নাকি তার মাত্র দুটি পোশাক ছিল। একটা ক্রিকেটের জার্সি আর একটা স্কুলের ইউনিফর্ম।
এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ফার্স্ট ম্যান’ কোহলির জনপ্রিয়তা শিখরে। কোহলি আজ আর নিছকই কোনো ক্রিকেটার নন, সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, শচীন টেন্ডুলকার, অনিল কুম্বলেদের পরবর্তী সময় ভারতীয় ক্রিকেটের রূপকথার নায়ক তিনি। দিল্লির বিশাল ভারতী পাবলিক স্কুল থেকে কোহলি তার জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। মাত্র ৩ বছর বয়স থেকেই তিনি ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। ছেলের এমন ক্রিকেটের টান দেখে মাত্র ৯ বছর বয়সেই বাবা প্রেম কোহলি ছেলেকে দিল্লি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেখানে কোচ রাজকুমার শর্মার তত্ত্বাবধানে ক্রিকেট শেখা শুরু করেন কোহলি। প্রতিদিন বাড়িতে অনুশীলন, একাডেমিতে অনুশীলনে নিয়ে যাওয়া সব কিছুতেই তার বাবার হাত ছিল। এরপর মাত্র ১৫ বছর বয়সেই দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৫ দলে সুযোগ পেয়ে যান। ২০০২-২০০৩ সালের পল্লী উমরিগার ট্রফিতে সর্বোচ্চ রান করে ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছিলেন। পুরস্কার নিয়েছিলেন সে সময়কার সাড়া জাগানো ভারতীয় পেসার আশিষ নেহারার হাত থেকে।
২০০৬ সালের জুলাইয়ে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলার জন্য ডাক পান কোহলি। ভারতের নীল জার্সিতে তার প্রথম সফর ছিল ইংল্যান্ডে। ২০০৮ সালে দলের অধিনায়কের ভার বহন করেন কোহলি। সে বছর মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জেতেন অধিনায়ক কোহলি। সে বছরই ২০ লাখ ভারতীয় রূপিতে আইপিএলের দল রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতে ডাক পান। ২০০৮ সালের আগস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ডাম্বুলায় কোহলির ওয়ানডে অভিষেক হয়। নিজের প্রথম ওয়ানডেতে মাত্র ১২ রান করেন। এখন ওয়ানডেতে তার রান সাড়ে ১১ হাজারের উপরে। সেঞ্চুরি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩টি। ২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কিংসটনে টেস্টে অভিষেক হয় তার। সাদা পোশাকে তার সেঞ্চুরির সংখ্যা ২৬টি।
২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর গাটছড়া বাঁধেন কোহলি। দীর্ঘদিনের প্রেমিকা বলিউড অভিনেত্রী আনুষ্কা শর্মাকে বিয়ে করেন তিনি। ৪ বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের সিয়েট ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার, ২০১২ সালে আইসিসি ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার, ২০১৩ সালে অর্জুন পুরস্কার, ২০১৭ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার, ২০১৬ সালে উইজডেন লিডিং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার, ২০১৭ সালে আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার, আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট একাদশের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন কোহলি। ধ্যান জ্ঞান যার সব ক্রিকেটে, তার পারফরম্যান্সটা তো ধারাবাহিক হবে সেটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ সময়: ০০১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৯
এমআরপি