চট্টগ্রাম: তিনশ বছর পূর্বে চতুর্দশী তিথিতে সীতাকুণ্ডের পাহাড় চূড়ায় শিব দর্শনের পথ ধরে এখনও চলছে পুণ্যার্থীদের পরিক্রমা। সারা বছর আনাগোনা থাকলেও বছরের এই সময়টাতে বাড়ে ভিড়।
সীতাকুণ্ড তীর্থধামের পণ্ডিত রাজীব ভরদ্বাজ জানান, মেলা ১৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হলেও শিব চতুর্দশী তিথি শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টা ৩৬ মিনিটে শুরু হয়ে থাকবে রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৪টা ৮ মিনিট পর্যন্ত।
দেখা গেছে, চন্দ্রনাথ ধাম ঘিরে পুণ্যার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ। প্রতিবছর এ মেলায় ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যোগ দেন। শিব দর্শনের আগে ব্যাস কুণ্ডে স্নান এবং পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ, তর্পণ, গয়াকুণ্ডে পিণ্ডদানসহ নানান ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা হচ্ছে। ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে তীর্থ এলাকা।
শাস্ত্র বলছে, ‘লিঙ্গ’ শব্দটির উৎপত্তি সৎস্কৃত ‘লিঙ্গম্’ থেকে, যার অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। ধ্যানমগ্ন শিবের প্রতীক এই শিবলিঙ্গ। মহাদেব আত্মধ্যানে স্বরূপে লীন থাকেন, মানুষকেও উপদেশ দেন আত্মনিমগ্নতার। ‘লয়ং যাতি ইতি লিঙ্গম্, লয়ং গচ্ছতি ইতি লিঙ্গম’ অর্থাৎ যাঁর মধ্যে সমস্ত কিছু লয় প্রাপ্ত হয়, তা-ই লিঙ্গ। যা শরীরের মধ্যে লীন হয়ে থাকে এবং যার অনুপস্থিতিতে দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়, সেটাই লিঙ্গ। বীজের মধ্যে যেমন বীজের অঙ্কুরিত হওয়ার শক্তি এবং ক্রিয়া লুকিয়ে থাকে, তেমনভাবেই এই ত্রিভুবনাতীত সংসারে যার মধ্যে শক্তিরূপে ক্রিয়া করে সেটাই লিঙ্গ।
বরিশাল থেকে পরিবার নিয়ে মেলায় এসেছেন অনিল দাশ। তিনি বলেন, রিজার্ভ বাস নিয়ে শিব চতুর্দশী মেলায় এসেছি। তীর্থযাত্রীরা মঠ-মন্দির দর্শন করছে। আজ (শনিবার) বিকেলে শিব চতুর্দশীর স্নান শেষে চন্দ্রনাথ ধাম দর্শন করবো।
দিনাজপুরের পুণ্যার্থী মনিবালা দে বলেন, শিব চতুর্দশী তিথি শুরুর পর ব্যাস কুণ্ডে স্নান সেরে চন্দ্রনাথ মন্দির দর্শনে উঠবো। পরিবারের মঙ্গল কামনায় ডাবের জল ও দুধ দিয়ে শিব স্নান করাবো।
সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ ধাম এলাকায় অসংখ্য মঠ-মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বটতলী কালী মন্দির, শনি মন্দির, প্রেমতলা মন্দির, সত্যনারায়ণ মন্দির, শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম, ব্যাসকুণ্ড, ভৈরব মন্দির, সূর্যকুণ্ড, শংকর মঠ ও মিশন, রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, জগন্নাথ মন্দির, মোহন্ত আস্তানা, ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ, শ্মশান কালীমন্দির, হনুমান মন্দির, উনকোটি শিবেরবাড়ি, রামকুণ্ড, লক্ষ্মণ কুণ্ড, সীতাকুণ্ড, নারায়ণছত্র, সীতার পাতালপুরী, দধিকুণ্ড, জ্বালামুখী কালীবাড়ি, গুরুধ্বনি, অন্নপূর্ণা মন্দির, স্বয়ম্ভূনাথ মন্দির, বিরূপাক্ষ মন্দির ও পাহাড় চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির।
ত্রেতাযুগে শ্রী রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষণ ঋষিদের সঙ্গে নিয়ে সীতাকুণ্ডে এসেছিলেন। ওই ভ্রমণের স্মৃতি অনুসারে সীতা পাহাড় এবং সীতাকুণ্ডের নামকরণ করা হয়। শাস্ত্র বলছে, কলিযুগে দেবাদিদেব মহাদেব (শিব) শিব চর্তুদশীতে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থান করেন।
সীতাকুণ্ড রেলস্টেশন মাস্টার সৈকত দেবনাথ বলেন, বুধবার থেকে সীতাকুণ্ড স্টেশনে থামছে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম মেইল, কর্ণফুলী কমিউটার, ময়মনসিংহ থেকে বিজয় এক্সপ্রেস, ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস, সিলেট থেকে আসা উদয়ন ও পাহাড়িকা এক্সপ্রেস, চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা মেঘনা ও সাগরিকা এক্সপ্রেস। এ ছাড়া সীতাকুণ্ড থেকে ছেড়ে যাচ্ছে সাগরিকা কমিউটার, কর্ণফুলী কমিউটার, ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস ও ঢাকা মেইল। ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা এসব ট্রেন সীতাকুণ্ড স্টেশনে দুই মিনিট করে যাত্রাবিরতি করছে।
মেলা কমিটির সভাপতি ও সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহাদাত হোসেন বলেন, তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পাঁচটি ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। পুলিশের প্রায় ৫০০ সদস্য নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে। এ ছাড়া ড্রোনের মাধ্যমে পুরো এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ছয়টি পয়েন্টে রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে রয়েছে চিকিৎসকদের একটি দল।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩
এসি/টিসি