ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পোড়ামাটি বলছে বাংলাদেশের ইতিহাস

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০২৪
পোড়ামাটি বলছে বাংলাদেশের ইতিহাস ...

চট্টগ্রাম: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রক্তাক্ত রাজপথ। বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচিয়ে দিচ্ছেন সাতই মার্চের ভাষণ।

রিকশায় পড়ে আছে হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদের মরদেহ। রাইফেল হাতে ছুটছে দামাল ছেলে।
অস্ত্রহাতে মা-বোনেরা। জীবন হাতে বাঙালি শরণার্থীদের ছুটে চলা। পাকবাহিনীর কালোরাত্রির সেই ট্যাংক। অপারেশন জ্যাকপট। বধ্যভূমি। নিয়াজির আত্মসমর্পণ থেকে স্মৃতিসৌধ।  

পোড়ামাটির টেরাকোটায় ১৯৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত শিহরণ জাগানো উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি তুলে ধরা হচ্ছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনের দেয়ালে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি আসার আগেই নবনির্মিত চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে শহীদ মিনারের কাজ শেষ করতে বিরামহীন কাজ করছেন শিল্পীরা। এখন ফিনিশিং টাচ দিচ্ছেন। স্থাপত্য অধিদপ্তরের নকশায় এ শিল্পকর্ম তৈরি করা হচ্ছে।  

সরেজমিন দেখা গেছে, প্রায় ২৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের অধীনে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আগের নকশায় নতুন করে নির্মিত হয়েছে। পোড়ামাটির শিল্পকর্ম শহীদমিনারের দেয়ালে বসানোর কাজ শেষ। তা দেখতে কৌতূহলী মানুষের ভিড়। টেরাকোটা বলছে বাংলাদেশের ইতিহাস। দর্শকদের চোখেমুখে বিস্ময়। যদিও এ জনপদে এটাই পোড়ামাটির প্রথম শিল্পকর্ম নয়। ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে টেরাকোটায় নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এ ধরনের ম্যুরাল রয়েছে জামালখানের ডা. খাস্তগীর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালে। টেরাকোটার ম্যুরাল রয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে। কিন্তু শহীদ মিনারের ম্যুরালটির ক্যানভাস সবচেয়ে বড়। এর ইতিহাস বর্ণনার ব্যাপ্তিও বিশাল।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। প্রভাত ফেরি। সাত বীর শ্রেষ্ঠ। প্রথম শহীদ মিনার। বর্তমান জাতীয় শহীদ মিনার। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন। ছয় দফা। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। অপারেশন জ্যাকপট। স্বাধীনতা। যুদ্ধকালীন উদ্দীপনা জাগানো পোস্টার। ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় তুলে ধরা হয়েছে পোড়ামাটির শিল্পকর্মে।  

চমৎকার হয়েছে লেখাগুলো। বিশেষ করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। ‘পুলিশের গুলীতে ছাত্র নিহত’। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো বাংলাদেশ মুক্ত করো’। ‘মা বোনেরা অস্ত্র ধর বাংলাদেশ মুক্ত কর’। ‘এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি’। ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’। ‘বাংলার হিন্দু বাংলার খৃষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালী’।  ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’। ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’। ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না’।  

মনোযোগ দিয়ে পোড়ামাটি দেখছিলেন মোহাম্মদ সোলায়মান নামের এক তরুণ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সড়ক থেকে শহীদ মিনারটি খুব একটা দেখা যায় না বললেই চলে। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আমি বিস্মিত। বিশাল জায়গা এখানে। সবচেয়ে বড় কথা পোড়ামাটির শিল্পকর্মে বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে।  

প্রকল্প পরিচালক গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বাংলানিউজকে বলেন, স্থাপত্য অধিদপ্তরের নকশায় এ শিল্পকর্ম স্থাপিত হচ্ছে। সাতক্ষীরা ও ঢাকা থেকে টেরাকোটার শিল্পকর্ম এনেছেন শিল্পীরা। এখন ফিনিশিং টাচের কাজ চলছে। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে ঘিরে এ প্রকল্পের আওতায় টেরাকোটার আরও অনেক কাজ হবে।  

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের নভেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স  প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। এর আগে ২০১৫ সালের মার্চে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মুসলিম হল সংস্কারের লক্ষ্যে নকশা প্রণয়ন কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের আগস্টে নকশা চূড়ান্ত হয়। একনেকে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে করোনা মহামারি ও আর্থিক সংকটে দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হয় প্রকল্পটির। সব ঠিক থাকলে ২০২৪ এর জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।  

প্রকল্পের আওতায় ১৫২১২.২৮ বর্গফুট জায়গায় ১৫ তলা বিশিষ্ট ১টি চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার, ১৪৪৯৩.২২ বর্গফুট আয়তনের ১টি মাল্টিপারপাস হল ও সেমিনার হলের পাশাপাশি ৭৪১৩.৬০ বর্গফুট আয়তনের জনসমাগম স্থান তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনঃসংস্কার কাজ। মূল সড়কের দুই পাশে যাতায়াতে তৈরি হয়েছে টানেল।  

গণগ্রন্থাগার ভবনের নিচতলায় থাকছে সার্ভিস সেকশন, যেখানে বই বাছাই, ফিউমিগেশন হবে। গ্রাউন্ড ও প্রথম ফ্লোরে থাকছে অফিস, ২য় ফ্লোরে সেমিনার ও মিটিং রুম, প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে তৃতীয় ফ্লোর।  চতুর্থ ও পঞ্চম ফ্লোরে জেনারেল লাইব্রেরি, ষষ্ঠ ফ্লোরে চিলড্রেন লাইব্রেরি, সপ্তম ফ্লোরে পেপার লাইব্রেরি, অষ্টম ফ্লোরে রেফারেন্স লাইব্রেরি, নবম ও দশম ফ্লোরে সায়েন্স লাইব্রেরি, ১১তম ফ্লোরে ট্রেনিং ইউনিট, ১২তম ফ্লোরে আইসিটি ইউনিট, ১৩তম ফ্লোরে স্পেস ফর ফিউচার প্রোভিশন, ১৪তম ফ্লোরে গেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হচ্ছে।

গ্রন্থাগার অংশে সাধারণ পাঠাগারে ২৫০ জন, বিজ্ঞান পাঠাগারে ১৫০ জন, রেফারেন্স পাঠাগারে ১০০ জন, পত্রিকা/সাময়িকী পাঠাগারে ১০০ জন, প্রতিবন্ধী পাঠাগারে ৫০ জন, উন্মুক্ত পাঠাগারে ১৫০জন, শিশু-কিশোর পাঠাগারে ১০০ জন পাঠক একসঙ্গে বসে বই পড়তে পারবেন।

এছাড়া ৪০ থেকে ৫০ আসন বিশিষ্ট সভাকক্ষ ও সেমিনার কক্ষ, ১৫০ আসন বিশিষ্ট একটি বড় সেমিনার কক্ষ নির্মাণ হবে। আইসিটি লাইব্রেরিতে থাকবে ৩০টি কম্পিউটার। থাকবে ১টি রেস্ট হাউজ, ২টি ভিআইপি কক্ষ ও সাধারণ ডরমেটরি কক্ষ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০২৪
এআর/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।