ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ত্রিপুরা পল্লীতে কিছুক্ষণ

ঝড়-জলের অপেক্ষায় রোজালিন-রেজিনা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৫
ঝড়-জলের অপেক্ষায় রোজালিন-রেজিনা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বান্দরবান ঘুরে এসে: প্রতিবছর শীত আসে। সেই শীত কষ্ট নিয়ে আসে রোজালিন-রেজিনাদের জীবনে।

শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে নেমে আসা জলের ধারা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। জল নিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে থাকা রোজালিনরা অপেক্ষায় থাকেন কখন শীত পার হয়ে গ্রীষ্ম শেষ হবে।
চাতক পাখির মত তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় বর্ষায় যখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে।

বান্দরবান সদর উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হাতিভাঙ্গা পাড়ায় ত্রিপুরা পল্লীর বাদুহা ত্রিপুরার মেয়ে রোজালিন ত্রিপুরা ও রেজিনা ত্রিপুরা। সেই পল্লীতে এবারও এসেছে শীত। সঙ্গে নিয়ে এসেছে পানির দুর্ভোগও।

২২ বছর বয়সী রেজিনা, প্রায় ৬০ বছর বয়সী কুমারি ত্রিপুরা কিংবা ছয় বছর বয়সী শিশু নাইয়ার ত্রিপুরা, সবাইকে মাইলের পর মাইল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় স্নানে। আর খাওয়া-রান্নার পানির জন্যও পাড়ি দিতে হয় পাহাড়ের পর পাহাড়।

সম্প্রতি হাতিভাঙ্গা পাড়ায় গেলে দেখা হয় রেজিনা, রোজালিনদের সঙ্গে। রেজিনা ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর শীতকাল এলে আমাদের কষ্ট শুরু হয়। ঝিরিতে (ঝর্ণা) পানি থাকেনা। পাহাড়ের ছড়ায় শুকিয়ে যায়। খাওয়ার পানির জন্য সকালে গেলে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। আর দুপুরে গেলে রাত ১০টার আগে ফেরা যায়না।

হাতিভাঙ্গা পাড়ায় বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেই পাড়ায় ৪০টি ত্রিপুরা পরিবারের বসবাস। অধিবাসী প্রায় ৩০০। এই পাড়া ঘিরে যেসব পাহাড় আছে প্রায় সবই খুবই উঁচু এবং দুর্গম।

এসব পাহাড়ে কমপক্ষে ৬টি ঝর্ণা আছে, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে সব ঝর্ণাতেই তেমন জল থাকেনা। পাহাড়ের পর পাহাড় ঘুরে কোন ঝর্ণা কিংবা ছড়ায় জল পেলেই দ্রুত স্নান সেরে নেন হাতিভাঙ্গা পাড়ার বাসিন্দারা।

রোজালিন ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, বর্ষকালে ঝিরি (ঝর্ণা) দিয়ে যে পানি আসে তা খুব পরিস্কার। শীতকালে ঝিরির পানির সাথে পাতা আছে। পানিও লাল। স্নান করতে খুব কষ্ট হয়। স্নানের পর শরীরে লাল ল‍াল চাক হয়ে যায়।

বয়োবৃদ্ধ পুরুষ অংঝারাই ত্রিপুরা (৬৫)। তার চার ছেলে ও ছেলের বৌ। সংসারে মানুষ বেশি হওয়ায় পানির দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের সবচেয়ে বেশি।

অংঝারাই ত্রিপুরা জানালেন, ছেলের বৌ পাহাড়ে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করে। তারা পাহাড়ে গিয়ে সেই পানিতে তাকে স্নান সেরে নেয়ার জন্য বললেও তিনি করেন না। তিনি পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ঝিরিতে যান স্নান সারতে।

হাতিভাঙ্গা পাড়ার কার্বারির স্ত্রী কুমারি ত্রিপুরা (৬০) বাংলানিউজকে বলেন, ৪০ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকেই বছরে ৮ মাস পানির কষ্ট করছি।

তিনি বলেন, আগে পাহাড়ে গাছপালা বেশি ছিল, সেজন্য ঝিরি দিয়ে কিছুটা পানি হলেও আসত। ছড়ায় পাথর ছিল, পানি আটকে থাকত। এখন গাছও কমে যাচ্ছে আর ছড়া থেকে তো পাথর তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পানি আটকানোর জায়গা নেই।

হাতিভাঙ্গা পাড়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ছড়াপথে হেঁটে দেখা গেছে, ছড়ার মাঝে মাঝে স্যানিটারি রিং বসিয়ে গর্তের মত করা হয়েছে। সেখানে এসে জমা হচ্ছে পানি। সেই পানিতে স্নান সারছেন লোকজন।

হাঁটতে গিয়ে দেখা মিলল আখা ত্রিপুরা (৩৩) আর রংবাপতি ত্রিপুরার (৩৫)। তারা জানালেন, প্রতিদিন সকালে তারা বাগানে চলে যান। সেখান থেকে দুপুরে এসে ঝিরিতে জল খুঁজতে পাহাড়ে চলে যান। কোনদিন জল পেলে তাদের স্নান করা হয়। অন্যথায় স্নান ছাড়াই তাদের দিনের পর দিন কাটাতে হয়।

রুমাতি ত্রিপুরা তার মেয়ে মনিকাকে নিয়ে স্নান সেরে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলেন বাড়ি। রুমাতি ত্রিপুরা বাংলানিউজকে জানান, বাজার সেরে একেবারে স্নান করে তারা বাড়ি ফিরছেন। বাজারে যাবার আগে কলসি রেখে এসেছেন কারিতাসের জলাধারে। কিন্তু সেখানেও পানি নেই।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস হাতিভাঙ্গা পাড়ায় প্রবেশ পথে পাহাড়ের উপরে কয়েকটি পরিকল্পিত জলাধার তৈরি করেছে। বিভিন্ন ঝিরি (ঝর্ণা) থেকে পানি সংগ্রহ করে পরিশোধনের মাধ্যমে জলাধারে জড়ো করা হয়। সেই পানি সংগ্রহ করে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করেন হাতিভাঙ্গা পাড়ার অধিবাসীরা।

রেজিনা ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, ঝিরিতে তো শীতে পানি কম থাকে। তাই কূপেও (জলাধার) পানি থাকেনা। পানি একটু-আধটু যা পাই, পুরো পাড়ার মানুষ ভাগ করে ব্যবহার করি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad