ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সালতামামি-২০২১

‘মানুষখেকো’ নালা-খাল আতঙ্কে ছিল চট্টগ্রাম

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২১
‘মানুষখেকো’ নালা-খাল আতঙ্কে ছিল চট্টগ্রাম ...

চট্টগ্রাম: জলজ্যান্ত মানুষটি নালায় পড়ে মুহূর্তেই ‘নেই’ হয়ে গেলেন। সিসিটিভি ফুটেজের সেই দৃশ্য নাড়া দিয়েছে দেশবাসীকে।

ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। গত ২৫ আগস্ট মুরাদপুরে বৃষ্টির পানিতে নিখোঁজ হওয়া ছালেহ আহমেদের (৫০) খোঁজ আর মেলেনি।
 

তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভান্ডার দরবার শরিফে যাওয়ার জন্য মুরাদপুরে এসেছিলেন। ওখান থেকে বাসে করে দরবার শরিফে যাওয়ার কথা ছিল। সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ নিখোঁজের ঘটনায় সিডিএ ও সিটি করপোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করেছিল তদন্ত কমিটি।  

শুধু কি মুরাদপুর, নগরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ‘মানুষখেকো’ নালা আর খালগুলো ২০২১ সালে অন্তত পাঁচজনের প্রাণহানির সাক্ষী। কী বর্ষা, কী গ্রীষ্ম বছরজুড়ে রীতিমতো আতঙ্কে দিন পার করেছেন ভুক্তভোগীরা।  

সেই বাবার কথা মনে পড়ে

পথশিশু মোহাম্মদ কামালের ছবি হাতে চশমা খালের পাড়ে বিলাপ করছিলেন ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ বাবা কাউসার। কামাল বন্ধুর সঙ্গে প্লাস্টিকের বোতল কুড়াতে খালে নামে। একপর্যায়ে আবর্জনার স্তূপের নিচে তলিয়ে যায়। একজন উঠতে পারলেও কামাল শক্তিতে পেরে উঠেনি। তলিয়ে যায় সে।  

ষোলশহর ভূমি অফিসের পাশের চশমা খালে কামাল নিখোঁজ হলেও তিন দিন পর গত ৬ ডিসেম্বর ছোট্ট শিশুটির নিথর দেহ উদ্ধার করা হয় মুরাদপুরের মির্জা খাল থেকে।  

চশমা খালে ভেসে যান তারা

গত ৩০ জুন মেয়র গলি এলাকায় টিঅ্যান্ডটি কলোনির বাইলেন দিয়ে যাওয়ার সময় চশমা খালে পড়ে গিয়েছিল একটি সিএনজি অটোরিকশা। বৃষ্টির কারণে খালটি তখন ছিল পানিতে টইটম্বুর। পাহাড়ি ঢলের স্রোতও ছিল প্রচণ্ড। সেই স্রোতে ভেসে যান চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)। পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

শেহেরীন সাদিয়ার ফেরা হয়নি আর

চশমা কিনে মামার সঙ্গে বাসায় ফেরার পথে গত ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে এক টন আবর্জনা পরিষ্কারের পর উদ্ধার হয় সাদিয়ার মরদেহ।

ভাগনিকে উদ্ধারের জন্য মামা সঙ্গে সঙ্গে নালায় লাফ দেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। নালায় তরুণী পড়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। নালার বিভিন্ন অংশে খোঁজাখুঁজি করেন ডুবুরি দলের সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে নিখোঁজ হওয়ার স্থান থেকে ৩০ গজ দূরে ওই নালা থেকে নিথর মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। এরপর তা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, নগরে ৫৭টি খাল ও ছয়শ’ নালা রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্দতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের অধীনে রয়েছে বড় খাল ও বড় নালাগুলো। বাকি খাল ও নালা দেখভাল ও পরিষ্কারের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)। সিডিএ ও চসিকের সমন্বয়হীনতা, প্রকল্প এলাকায় বেড়া না দেওয়াসহ নানা কারণে খাল ও নালায় পড়ে মানুষ আহত এমনকি নিহতও হচ্ছে।  এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়া, সিডিএর মাস্টারপ্ল্যান উপেক্ষা করা, সেবা সংস্থাগুলোর ইউটিলিটি সার্ভিসের পাইপ লাইনগুলো নালার মাঝ বরাবর নিয়ে যাওয়া, অপচনশীল প্লাস্টিক, ফোম, পলিথিনসহ গৃহস্থালি বর্জ্যে  খাল ও নালা ভরে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে।  

কর্ণফুলী নদী গবেষক প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী বাংলানিউজকে বলেন, খাল, নালা ও নর্দমায় পড়ে এক বছরে ৫ জন মানুষ মারা যাওয়া দুঃখজনক। শরীরে যেমন খাদ্যনালি আছে তেমনি খাল-নালা-নর্দমা হচ্ছে নগরের খাদ্যনালি। এগুলো পরিষ্কার, নিরাপদ রাখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। একটি ভবন নির্মাণের সময় আমরা টিনের বেড়া, চটের বেড়া দিই নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু নালায় যে উন্নয়নকাজ চলছে সেখানে তেমনটি দেখা যায় না। আবার অনেক নালার পাশে সড়কে হাঁটু সমান প্রাচীর নেই। নয়তো একটি সিএনজি অটোরিকশা কীভাবে খালে পড়ে যায়? আসলে আমাদের উন্নয়নের পাশপাশি জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য ও জনসেবার বিষয়টিও দেখতে হবে। অন্যের ওপর দায় বা দোষ চাপিয়ে সমস্যা আড়াল করলে আরও বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২১ 
এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।