ঢাকা, বুধবার, ৩১ চৈত্র ১৪৩১, ১৫ মে ২০২৪, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চট্টগ্রামে ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষায় নেই উদ্যোগ

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২
চট্টগ্রামে ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষায় নেই উদ্যোগ ভাষা সৈনিক।

চট্টগ্রাম: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চলাকালে মিছিল-স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম। লালদিঘি ময়দানের জনসভায় সমবেত হয়েছিল ৫০ হাজারের বেশি মানুষ।

 

আন্দোলনে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন রেলওয়ে শ্রমিক লীগ নেতা চৌধুরী হারুনুর রশীদ, একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী, এম এ আজিজ, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আজিজুর রহমান, ডা. আনোয়ার হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান, এমএ মান্নান, মোজাফফর আহমদ, হাবিব উল্লা, নুরুজ্জামান, শামসুদ্দিন আহমদ, মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী, ইয়াহিয়া খালেদ, আবু জাফর, ডা. সাইদুর রহমান, আমির হোসেন দোভাষ, এজাহারুল হক প্রমুখ।  

ভাষা আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য ২০০৯ সালে তিন ভাষা সৈনিক কৃষ্ণ গোপাল সেন, আহমেদুর রহমান আজমী এবং অ্যাডভোকেট এ কে এম এমদাদুল হককে সংবর্ধনা দেয় চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

বার্ধক্যজনিত রোগে ২০১১ সালে ভাষার মাসে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরসরাইয়ের ইছাখালী ইউনিয়নের দেওখালী গ্রামে নিজ বাড়িতে মারা যান ভাষা সৈনিক আজমী। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে হাটহাজারী সদরে অনুষ্ঠিত হয় মিছিল ও সমাবেশ। ওই সমাবেশ থেকেই মাওলানা আজমীকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় হাটহাজারী থানা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পরে তিনি অন্তর্ভুক্ত হন চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে চারবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। কিন্তু এই ভাষা সৈনিকের স্মৃতি রক্ষার্থে নেওয়া হয়নি কোনও উদ্যোগ।

কৃষ্ণ গোপাল সেন (কালাচাঁদ) এর জন্ম রাউজানের কোয়েপাড়া গ্রামে ১৯২৯ সালের ২৪ নভেম্বর। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর ৯০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংগঠিত ছাত্রহত্যার পর চট্টগ্রামে যে ১৪ জনকে আটক করা হয়েছিল, কৃষ্ণ গোপাল তাঁদের একজন। দীর্ঘ ১০ মাস কারাগারে থাকা অবস্থায় একটানা ৪০ দিন অনশনের পর তিনি মুক্ত হন। নগরের দেওয়ানজী পুকুর পাড় এলাকায় তাঁর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। তবে রাউজানে নেই স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ।  

২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি ৮৪ বছর বয়সে মারা যান ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট এ কে এম এমদাদুল ইসলাম। নগরের জামালখানে ছিল তাঁর বসবাস। গণি বেকারি মোড়ের মিসকিন শাহ মাজার কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ১৯৩৩ সালের ১৮ মে ফটিকছড়ির ইমামনগরে জন্ম নেন তিনি। ১৯৪৮ সালে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ঝুঁকে পড়েন ভাষার আন্দোলনে। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দম্ভোক্তি সংবাদপত্রে দেখার পর তিনি ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।  

জেলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হবার পর এমদাদুল ইসলামের ওপর দায়িত্ব পড়ে ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট কলেজ এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার। ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে আহূত ছাত্র ধর্মঘট চট্টগ্রামেও সফল করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই ফটিকছড়িতে রেডিওর খবরে ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলিবর্ষণের সংবাদ পান। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠের সমাবেশে তিনি অংশ নেন। এই ভাষা সৈনিকের নামেও চট্টগ্রামে কোনও স্থাপনা নেই।

পটিয়ার মনসা গ্রামে জন্ম নেওয়া চৌধুরী হারুনুর রশীদ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রথম গ্রেফতার হন। ৪ বছর জেল খেটে ৫৬ সালে মুক্তি পান। মুক্তির ২ বছর পর সামরিক শাসন জারি হলে তার ওপর আবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তিনি একাধারে কমিউনিস্ট পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ন্যাপের সহ-সভাপতি, টিইউসি ও রেল শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ন্যাপ (মোজাফফর) এর প্রার্থী হিসেবে কুঁড়েঘর প্রতীকে চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০০০ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকেও ভুলতে বসেছে সবাই।

বোয়ালখালীর উত্তর ভূর্ষি গ্রামে ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি বিনোদ বিহারী চৌধুরীর জন্ম। ভাষা আন্দোলন চলাকালে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য। ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা রাজপথে মিছিল বের করলে তিনি মিছিলের মুখে পড়েন। তাদের দাবি জেনে সেদিনই আইন পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারের ভিত্তিতে আইনসভার কাজ বন্ধের আহ্বান জানান। এ ঘটনায় তৎকালীন স্পিকার আবদুল করিম সংসদ মুলতবি ঘোষণা করতে বাধ্য হন। বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

চট্টগ্রামের হালিশহরে ১৯২১ সালে জন্ম এমএ আজিজের। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি অনুযায়ী, ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ অফিসে সভা আহ্বান করা হয়। সভায় এম এ আজিজকে যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। তিনি শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছাত্রদের সংগঠিত করতেন।  

চট্টগ্রামে সর্বদলীয় ভাষা কমিটি গঠিত হয় জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের এম এ আজিজ এবং তমদ্দুন মজলিসের আজিজুর রহমানের উদ্যোগে। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের খবর ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পৌঁছালে ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে এক সভায় এম এ আজিজ বক্তব্য দেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে বক্তব্য দেন এম এ আজিজ। ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি ফটিকছড়িতে জনসভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রাউজানের গহিরা আসাদ চৌধুরী বাড়ির সন্তান মাহবুব উল আলম চৌধুরী ভাষা আন্দোলন নিয়ে একুশের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন- ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন কমিটির আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ ও এম এ আজিজ। ১৯ ফেব্রুয়ারি জলবসন্তে আক্রান্ত অবস্থায় খবর পান, একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ হঠাৎ গুলি চালিয়েছে। এতে শহীদ হন বরকত, রফিক, জব্বার, সালামসহ অনেকেই। ঢাকায় রক্তপাতের ঘটনায় মর্মাহত হন তিনি।  পুলিশি হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে বসে সন্ধ্যা সাতটায় ১২০ লাইনের সেই কবিতা লিখলেন। পরদিন কবিতাটি লিফলেট আকারে হাজার কপি ছাপা হয় আন্দরকিল্লার কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে।  

২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানের প্রতিবাদ সমাবেশে কবিতাটি পড়ে শোনান শ্রমিকনেতা চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতাটি পড়ার অপরাধে পরদিন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় কবিতাটি। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে জারি করা হয় হুলিয়া। বোরকা পরে গাড়িতে পর্দা টাঙিয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। একটানা ৯ মাস ছিলেন আত্মগোপনে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।

মাতৃভাষার দাবিতে চট্টগ্রামে বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের সঙ্গে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরাও অংশ নেন। নারীরা পোস্টার লিখেছেন, রাজপথে নেমেছেন। চট্টগ্রাম রাষ্ট্রভাষা কমিটির ডাকে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ধর্মঘট পালন, পোস্টার লেখা ও লাগানো, মিছিল এবং লালদিঘির ময়দানে সভায় অংশ নেন ভাষাসৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দি (একুশে পদকপ্রাপ্ত), মিরা সেন, জাহানারা রহমান, জওশন আরা রহমান, হোসনে আরা, হালিমা খাতুন প্রমুখ।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় চেমন আরা ছিলেন ঢাকা ইডেন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সমাবেশে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সংগঠিত করেন তিনি। সভা শেষে ছাত্রী মিছিলেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ভাষা শহীদ বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি যে মিছিল বের হয় সেই মিছিলেও ছিলেন চেমন আরা। ১৯৩৫ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও থানার ঐতিহ্যবাহী মৌলভী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন চেমন আরা। প্রায় ৩৬ বছর বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ২০০৪ সালে পেয়েছেন তমদ্দুন মজলিস ভাষা সৈনিক পদক। প্রাপ্তি শুধু এটুকুই।

তবে আরেক ভাষা শহিদ মো. রফিকের নামে পাহাড়তলী থানাধীন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম সংলগ্ন সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ভাষা শহিদ রফিক সড়ক’ নামে। এম এ আজিজ ও জহুর আহমেদ চৌধুরীর নামে হয়েছে স্টেডিয়াম।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, সড়কের নামকরণের জন্য পরিবার বা সংশ্লিষ্ট পরিষদ কিংবা ফাউন্ডেশন থেকে আবেদন করতে হয়। নামকরণ উপকমিটি তা যাচাই-বাছাইয়ের পর সুপারিশ করে। এ সিদ্ধান্ত মেয়র ও কাউন্সিলরদের সাধারণ সভায় উপস্থাপনের পর অনুমোদন পেলে সরকারের অনুমতির জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতে হয়। এরপরই কোনও সড়ক বা স্থাপনার নামকরণ চূড়ান্ত করতে পারে সিটি করপোরেশন।  

ইতিপূর্বে ভাষা সৈনিকদের নামে চট্টগ্রামে নতুন কোনও সড়কের নামকরণ প্রস্তাব করা হয়নি। তবে ভাষা সৈনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নামে লালদিঘির পাড় গণগ্রন্থাগারে স্মৃতিস্মারক স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে চসিক।  

এ প্রসঙ্গে নাট্যজন শেখ শওকত ইকবাল চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, কিভাবে আমরা মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পেলাম, কেনইবা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল উর্দুভাষীরা, কারা ছিলেন মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে- এসব ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে ভাষা সৈনিকদের ম্যুরাল, বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করা সহ নানান উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নইলে তাঁরা একসময় হারিয়ে যাবেন, যা আমরা প্রত্যাশা করি না।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।