কলকাতা: শীতকালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলো তিস্তা প্রকল্প থেকে সেচের পানি পাবে কীনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে প্রকৌশলীরা। এরমধ্যে আবার বাংলাদেশকে চাহিদা মতো আদৌ পানি দেওয়া সম্ভব কীনা তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ কল্যান রুদ্রকে দিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে- পানি বন্টনের বাস্তবিক হিস্যা খতিয়ে দেখার জন্য।
জলপাইগুড়ি জেলার কালিঝোরায় রয়েছে তিস্তা জলবিদুৎ প্রকল্প। বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী, এই জেলার জলডোবা থেকে তিস্তার পানির ৫০ শতাংশ দেওয়া হলে ওই প্রকল্পটি বছরের ৬ মাস বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে না।
এ দুটি সমস্যা নিয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী সুকুমার ঘোষ বলেন, আমরা শীতকালে বাংলাদেশকে পানি না দেওয়ার পক্ষে। এক্ষেত্রে আমি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবস্থানকে সমর্থন করি। এ সমস্যা সমাধানের কোন উপায় আমাদের কাছে নেই।
তিস্তার পানি বন্টনের মূল সমস্যা শীতকালে বা লিন পিরিয়ডে। বর্ষার মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গজলডোবা ব্যারেজের উত্তর অংশে তিস্তার পানি পরিমান গড়ে ৩ থেকে ৬ হাজার কিউসেক (প্রতি সেকেন্ডে)। তিস্তা সেচ প্রকল্পের বাম খাল ও ডান খালের মোট পানি প্রবাহের ক্ষমতা ৫১৪ কিউসেক প্রতি সেকেন্ড।
এর পাশাপাশি, কালিঝোরায় তিস্তা লো ড্যাম প্রজেক্ট-৪ এর চাহিদা ৪টি ইউনিটের জন্য ৭১৬ কিউসেক। অর্থাৎ বর্ষা মওসুমে তিস্তার পানি প্রয়োজন সর্বাধিক ৫১৪ কিউসেক। প্রবাহিত হচ্ছে গড়ে ৪ হাজার কিউসেক।
বর্ষায় সমস্যা না থাকলেও সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই ৬ মাসের লিন পিরিয়ডে। এই ৬ মাসে তিস্তার সেবক সেতু ও গজলডোবা ব্যারেজের উত্তর অংশে পানি প্রবাহিত হয় গড়ে ৮০ থেকে ১০০ কিউসেক।
কালিঝোরা সেবকের ৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। সেখানেও লিন পিরিয়ডে ৮০ থেকে ১০০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়।
এই কালিঝোরায় প্রজেক্ট চালিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৪টি ইউনিট চালাতে হলে ৭১৬ কিউসেক পানি দরকার। একটি ইউনিটের জন্য দরকার ১৭৯ কিউসেক পানি।
লিন পিরিয়ডে পানি প্রবাহকে ঠিক রাখতে একটি জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে। এই জলধারের ধারণ ক্ষমতা ৭ দশমিক ৯১ মিলিয়ন কিউসেক। লিন পিরিয়ডে তিস্তার পানি প্রবাহ সম্পূর্ণ আটকে এই জলধার ভরতি করতে নূন্যতম সময় লাগবে সাড়ে ২২ ঘণ্টা।
এই সাড়ে ২২ ঘণ্টা সেবক অঞ্চলের তিস্তা থাকবে পুরো পানি শূণ্য। এরফলে গজলডোবায় পানি না আসার ফলে ব্যারেজও থাকবে না পানি।
সাড়ে ২২ ঘণ্টা ধরে তিস্তার পানি দিয়ে জলাধার ভরতি করে ৪টি ইউনিট একসঙ্গে চালালে ৩ ঘণ্টা ১০ মিনিটেই পানি শেষ হয়ে যাবে। যদি ২টি ইউনিট চালানো হয় তাহলে ৬ ঘন্টা ২০ মিনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এই হিসাবে শীতকালে এই প্রকল্প ন্যূনতম ৩ ঘণ্টা এবং সর্বাধিক ৬ ঘণ্টা চলবে।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্প যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত তিস্তায় পানি প্রবাহিত হবে। কারণ পানি ব্যবহারের পর তা আবার তিস্তায় ফিরে আসবে। এরফলে শীতকালে তিস্তায় আসবে সর্বাধিক ৭১৬ কিউসেক ও গড়ে ৩৫৮ কিউসেক পানি। এই পানি আসবে ৩ ঘণ্টা ধরে।
২১ ঘণ্টা ধরে নদী শুকিয়ে থাকলে ৩ ঘণ্টায় যে পানি প্রবাহিত হবে তার মধ্যে ন্যূনতম ১০০ কিউসেক (প্রতি সেকেন্ডে) মাটি শুষে নেবে ১৮ কিলোমিটার নদী পথে। সেবক থেকে গজলডোবার দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। গজলডোবা ব্যারেজে পানি আসবে ৩ ঘণ্টা এবং গড়ে ৬০০ কিউসেক (প্রতি সেকেন্ড)।
তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য মোট চাহিদা ৫১৪ কিউসেক। তা সরবারহ হবে ৩ ঘণ্টায়। এরমধ্যে বাংলাদেশকে ৫০ শতাংশ দিলে উত্তরের জেলাগুলোর জন্য পানি থাকবে মাত্র ২০৭ কিউসেক। এই পানি ৩ ঘণ্টায় দেওয়া যাবে। এর ফলে জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির চাহিদাই পূরণ হবে না। দুই দিনাজপুর এবং মালদা পর্যন্ত পানি যাবে না।
পরিস্থিত জটিল হবে অদূর ভবিষ্যতে। কারণ, এই তিস্তার ওপর পাহাড়ে মোট ৪টি প্রকল্প আছে। ফলে শীতকালে তিস্তার পানির গতি চারবার নিয়ন্ত্রিত হবে। শুধু সেচ বা বিদ্যুৎ নয়। এর প্রভাবে হিমালয় সংলগ্ন এই অঞ্চলে জৈব বৈচিত্রের সমস্যা দেখা দেবে।
তথ্যসূত্র : উত্তরবঙ্গ সংবাদ জুন ২৩, ২০১২
বাংলাদেশ সময় : ১১০৭ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১২
আরডি/ সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর
[email protected]