কলকাতা : সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী চিরতরুণ কবি। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্য ও মা সুনীতি দেবী।
কলকাতা শহরে তার স্মৃতি গত কয়েক দশকে অজ্ঞাত কারণে ধীরে ধীরে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। তার স্মৃতি কতটুকু রক্ষা করার চেষ্টা হয়েছিল তা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম‘র কলকাতা ব্যুরো চিফ রক্তিম দাশ।
১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট মাতামহের কলকাতার কালিঘাট কালিমন্দির সংলগ্ন ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে তার জন্ম। মৃত্যু ১৩ মে ১৯৪৭। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই বাড়িটির অস্তিত্ব ছিল।
এরপরই তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে কালিঘাট থানা থেকে হাজারা রোড ফায়ার বিগ্রেড ক্রশিং পর্যন্ত একটি সড়ক তৈরী হওয়ার কাজ শুরু হয়। এই সড়কটি বর্তমানে ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জি রোডকে সংযুক্ত করেছে।
কলকাতার উন্নয়নের কারণে সড়কটির মধ্যে বাড়িটি একটি বড় অংশ পড়ে যাওয়ার কারণে তা ভাঙা পড়ে। এরপর ১৯৭৬ সালে ওই বাড়িটির অবশিষ্ট অংশ ভেঙে কালিঘাট সুকান্ত স্মৃতি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে কবি সুকান্ত পাঠাগার নামেরএকটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়।
যা এখন বিদ্যমান। এখানে এখন আর কবির কোনই স্মৃতি চিহ্ন নেই। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে। পাশের বাড়িটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ছোট ভাই বিভাস ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রী বাসন্তী ভট্টাচার্য।
বাংলানিউজকে বিভাস ভট্টাচার্য বলেন, ৩৪ নম্বর আর ৩৮ নম্বর হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়ি ২টি ছিল আমাদের। বুদ্ধর বাড়ি (পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) আর আমাদের বাড়ি। একই সঙ্গে ছিল। জয়েন্ট ফ্যামিলি।
৩৮ ছিল টোল বাড়ি। ওখানে সংস্কৃত টোল ছিল। পড়াশোনা হত। আর ৩৪ নম্বর পাকা বাড়িটা ছিল আমাদের বসত বাড়ি। জ্যাঠামশাই, জ্যাঠতুতো ভাই সবাই আমরা একসাথে থাকতাম। বুদ্ধর তখন জন্ম হয়নি।
তিনি বলেন, ওই ৩৪ নন্বর দোতলা পাকা বাড়িটির উপরের তলার ঘরে উনি থাকতেন।
বাসন্তী দেবী বলেন, সুকান্তর জীবদ্দশার শেষ দিকে ৬ হাজার টাকায় বাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। অপরিসর সিমেন্টর পাকা রাস্তায় ৩৪ নম্বর হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িটি এখন কবি সুকান্তের স্মৃতি নিয়ে বিদ্যমান।
হাতবদল করে এখন মালিকানা জনৈক বসু পরিবারের হাতে। তাদের আবার অনেক শরিক। বাড়িতে আছেন একঘর অবাঙালি ভাড়াটে। তার সাথে মামলা চলছে বলে জানা গেল। বাড়ি দরজায় লেখা টি পি সাউ।
এরই উল্টো পাশে ৩৯ নম্বর বাড়ি। এই বাড়ি দেওয়ালেই কবি চারকোল দিয়ে একটি কবিতা লিখছিলেন বলে জানা যায়। এই বাড়িটিও একইরকম আছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জানা গেল, এই মহল্লায় আছে কবির হাতে প্রতিষ্টিত একটি লাইব্রেরি। যেটি ৪০ বছর ধরে বন্ধ মামলার কারণে। এখন তা সাপখোঁপের আস্তানা।
কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে কবির পরিবারের একটি প্রকাশনী ছিল। যার নাম সারস্বত লাইব্রেরি। এই প্রকাশন সংস্থা থেকেই কবি সুকান্তের সবকটি লেখা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে এটিও বন্ধ।
২০০৭ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার রবীন্দ্রসদনের বাংলা একাডেমী সভাঘরে এক অনুষ্টানে তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী ও কবির ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর হাতে সুকান্তের স্বহস্তে লেখা ৩৫০ পাতার পান্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য তুলে দেন কবির ভাই অশোক ভট্টাচার্য। এদিনই কবির ভাইঝি মালবিকা ভট্টাচার্য ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র স্বাধীনতা পত্রিকার সুকান্ত সংখাটিও তুলে দেন সংরক্ষণের উদ্দেশ্য।
এদিন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রতিশ্রুতি দেন তার মাকে লেখা কাকার চিঠি তিনি তুলে দেবেন সংরক্ষণের জন্য। এদিনে অনুষ্টানের বলা হয়েছিল- এই সব কিছু জনসাধারণ ও গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রতিশ্রতিই সার। আজও তা জনসমক্ষে আনা হয়নি।
বাসন্তী দেবী আক্ষেপ করে বলেন, কিছুই হল না। ওর বসত বাড়িটা চাইলে রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করতে পারতো।
এই ভাবেই কবি সুকান্তের স্মৃতি চিহ্ন গুলো একটু একটু করে হারিয়ে যাবে শহর কলকাতা থেকে। ক্ষণজন্মা কবি বোধহয় এটা জানতেন, তাই হয়ত লিখেছিলেন.....
দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন
নতুন, নতুনতর বিশ্ব
তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা
একে একে সকলি অদৃশ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১২
আরডি/