কলকাতা থেকে: ভারতের ভোটের মাঠে তারকাদের দাপট বেশ বেশিই দেখা যাচ্ছে এবার। মডেল, অভিনেতা, অভিনেত্রী, শিল্পী, খেলোয়াড় কে নেই এবারের লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকায়! বিশেষ করে পুরো পশ্চিমবঙ্গ এখন তারকাময়।
কিন্তু রাজনীতিতে তারকাদের এমন উড়ে এসে জুড়ে বসাটা ভালোভাবে নিচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। এমনকি দলগুলোর ভেতরেও এ নিয়ে চরম অস্বস্তি ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
কলকাতার আমজনতা ও বিভিন্ন দলের কর্মীর সঙ্গে কথা বলে এই অসন্তোষের আঁচটা ভালোই টের পাওয়া গেলো।
সর্বভারতীয় এবং আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে তৃণমূলই বাছাই করেছে সর্বাধিক তারকা প্রার্থী। যদিও এমন প্রয়াসে কম খুব একটা পিছিয়ে নেই প্রধান দু’দল কংগ্রেস আর বিজেপিও। ভোটের ময়দানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তারকা প্রার্থী আছে তাদেরও।
এক্ষেত্রে দলগুলো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নয়, বরং তারকাখ্যাতিকেই গুরুত্ব দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে দলীয় পরিমণ্ডলে।
সাধারণ মানুষ বলছে, যারা বছরের ৩৬৫ দিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত তারা কিভাবে আমজনতার কাছে পৌঁছুবে! কিভাবেই বা বুঝবে সাধারণ মানুষের চাহিদা!
রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতারা বলছেন, যেসব নেতা দিনের পর দিন দলের জন্য কাজ করেছেন, দল তাদের বঞ্চিত করেছে ভীষণভাবে। তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিশ্রমের কোনো মূল্যই দেয়নি দলগুলো।
অভিযোগের এই সুর সব দলের নেতার কণ্ঠেই এখন আক্ষেপ হয়ে ফুটছে।
গঙ্গার ধারে মিলেনিয়াম পার্কে বসে কথা হয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা অমিত কুমার রায়ের সঙ্গে।
তারকাপ্রার্থী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রুপালি জগতের তারকা হলেই রাজনৈতিক জগতেও তারকা হবেন এমনটা ভাবা দলগুলোর ঠিক হচ্ছে না। এর মাধ্যমে তারা জনগণকে ঠকাচ্ছেন। এছাড়া অতীত অভিজ্ঞতা বলছে- রুপালি জগতের তারকারা রাজনীতিতে ভালো করেন না। কোনো দলের পক্ষে দাঁড়ানোটা নিছক মানুষের চোখে ধুলি দেওয়া।
তার পাশে বসা স্কুল শিক্ষক অরবিন্দ স্যান্যাল বলেন, জনগণ ভোট তো দেবে, মুনমুন কিংবা বাপ্পি লাহিড়ীকে দেখে দেবে না। দেবে তৃণমূল, কংগ্রেস বা বিজেপিকে। কিন্তু তারপরও আমি মনে করি, তারকাদের রাজনীতির মাঠে এনে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। সবারই একটি নির্দিষ্ট জায়গা আছে। তারকাদের জায়গা পর্দার ভেতরে, বাইরে নয়। এটা ভুললে চলবে না।
কলকাতার মুরারি মোহন কলেজের ছাত্রী অর্পিতা রায় বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নিঃসন্দেহে তারকাদের ওপর আমাদের একটা মোহ আছে। দেব বলতে আমরা তরুণরা মাতাল। মুনমুন সেনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখেছি বাড়ির বড়দের মধ্যে। কলকাতায় এমন কোনো মানুষ নেই যিনি দিনে অন্তত একবার বাপ্পিদার সুর গুনগুন করেন না। মঞ্চে তাদের দেখেছি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে রাজনীতির মাঠে তাদের কল্পনা করিনি কখনো। হয়ত তারকাদের প্রতি এ মোহের কারণে ভোট দিতেও যাব। তবে সেটা সুনাগরিকের দায়িত্ব হবে না। কারণ, তাকেই নির্বাচিত করা উচিত যার সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আছে। এ জায়গাটিতে তারকাদের বিষয়ে সত্যি আমি সন্দিহান।
সোমা ব্যানার্জীও একই সুরে বলেন, সোনায় মোড়ানো বাপ্পিদা কি পারবেন কৃষকের ঘরে বসে তার দুর্দিনের গল্প শুনতে। তিনি তো ব্যস্ত থাকেন মুম্বাই শহরে। আর এখন ভোটের জন্য চষে বেড়াচ্ছেন নিজ এলাকা।
কিন্তু সেখানে তিনি গত ১০ বছরে কয়বার গিয়েছেন- প্রশ্ন তোলেন সোমা।
তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি ও কংগ্রেসের কলকাতা অফিস ঘুরে কথা হয় দলগুলোর স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে।
তারা বলছেন, তারকাদের নিয়ে প্রচারণা কাজেও বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণার চেয়ে মানুষ ভিড় জমাচ্ছে তাদের এক নজর দেখতে। শুধু তাই নয়, তারকারাও এতো মানুষের মাঝে এবং গরমে অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। এমনকি রাজনৈতিক বক্তব্যও দিতে পারছে না তারা। আর দিলেও বক্তব্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে বিতর্ক।
সম্প্রতি বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী চিত্রনায়িকা শতাব্দী রায়ের দেওয়া এক ভাষণকে কেন্দ্র করে দল খানিকটা চাপে পড়ে। কারণ, শতাব্দী বলেন, ‘আমাকে যে বেশি ভোট দেবে, সেই গ্রাম, সেই পঞ্চায়েত, সেই এলাকাগুলোর বেশি উন্নতি করব। যারা কম ভোট দেবে, তাদের উন্নতি হবে কম। তাই আমাকে বেশি বেশি ভোট দিন। ’
এমন বক্তব্য কোনো রাজনৈতিক নেতার পক্ষে শোভন নয় বলে মন্তব্য করেন এক তৃণমূল কর্মী।
আলীমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে এক বাম ফ্রন্ট্রের নেতা বাংলানিউজকে বলেন, যারা নিচু তলার কর্মী, যারা মানুষের সঙ্গে প্রতিদিন জনসংযোগ রাখেন তারাই আসল নেতা। সে জন্য আমাদের কোনো তারকাপ্রার্থী নেই। তারকাপ্রার্থী দেওয়ার অর্থ একটা রাজনৈতিক গিমিক (প্রতারণাপূর্ণ কৌশল) করা।
এ প্রসঙ্গে কলকাতার অর্থনীতিবিদ রাহুল সরকার রোববার সকালে বাংলানিউজকে বলেন, তারকা প্রার্থীকে দেখে মানুষের ভিড় জমছে, কিন্তু ভোটের বাক্সে এর খুব একটা প্রভাব পড়বে না।
অতীত ঘেঁটে তিনি বলেন, ২০০৯ এর লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের আসন কমে যায়। ২০১১ সালের বিধানসভাকে সামনে রেখে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রায় নয় লাখ মানুষ জমায়েত হয়। তা সত্ত্বেও বিধানসভা ভোটে বিরাট ব্যবধানে বামদের পরাজয় ঘটে। তাই ভিড় মানেই স্বতঃস্ফূর্ত ভোট নয়। এটা মনে রাখতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কংগ্রেস তারকা প্রার্থী দিলেও দলটির পশ্চিমবঙ্গের সব প্রার্থীই রাজনীতিবিদ। সেই জোরে মৌলালীতে প্রদেশ কংগ্রেস অফিস বিধান ভবনে বসে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মমতা ব্যানার্জি নিজেই একজন তারকা। পশ্চিমবঙ্গে গত তিন বছরের উন্নতির নামে যে কাণ্ড উনি করেছেন তাই তার নামে তারকা তকমা থাকবেই। আপনি তো বাংলাদেশের সাংবাদিক, আপনার দেশের সঙ্গেও কি মমতা কম নাটক করছেন!
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরা থেকে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মেয়ে মুনমুন সেন, ঘাটাইল থেকে এখনকার টালিউড তারকা দেব (দীপক অধিকারী), মেহিনীপুর থেকে চিত্রনায়িকা সন্ধ্যা রায়, কৃষ্ণনগর থেকে অভিনেতা তাপস পাল এবং বীরভুম থেকে অভিনেত্রী শতাব্দী রায়কে মনোনয়ন দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির দল।
এছাড়া তৃণমূলের হয়ে আরও লড়ছেন উত্তর মালদহ থেকে ব্যান্ড শিল্পী সৌমিত্র রায়, বালুরঘাট থেকে নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ এবং বহরমপুর থেকে সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রনীল সেন।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে চলচ্চিত্র তারকা তাপস পাল ও শতাব্দী রায় বিজয়ী হয়েছিলেন। তারা এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন। পশ্চিবঙ্গের বাইরে নয়াদিল্লি থেকে চিত্র নায়ক বিশ্বজিৎকে (টালিউড নায়ক প্রসেনজিতের বাবা) মনোনয়ন দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
পশ্চিমবঙ্গের শ্রীপুর থেকে সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী ও আসানসোল থেকে গায়ক বাবুল সুপ্রিয় এবং হাওড়া থেকে টালিউড তারকা জর্জ বেকার বিজেপির পদ্মফুল নিয়ে লড়ছেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও দলগুলোর অসংখ্য তারকাপ্রার্থী রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৪