কলকাতা: “ইউ ক্যাম্পেন ইন পোয়েট্রি । ইউ গভার্ন ইন প্রোজ”।
একটু ভেঙে বলা দরকার। যদি উত্তরের ররফে ঢাকা কাশ্মীর থেকে সরলরেখা ধরে দক্ষিণের কন্যাকুমারীর সমুদ্রতট পর্যন্ত, আবার পূর্বের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পশ্চিমের গুজরাটের রাজকোট কিংবা ভূজ-এর মাটিতে দাঁড়িয়ে যে-কোনো ভোটারকে দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি কি আশা করেন এই প্রশ্ন করা যায়, তবে তার জবাবটা হবে প্রায় একই রকম।
৬৬ বছর স্বাধীন হয়েছে ভারত। স্বাধীনতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে সমস্যার ধরন। এই ৬৬ বছরের বেশিরভাগ সময়টাই দিল্লির শাসন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। যেসব ক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে গেছে তার একটা বড় অবদান যে কংগ্রেসের আছে, সেটা কংগ্রেসের ঘোর বিরোধীও অস্বীকার করেন না। কিন্তু একথাও নির্দ্বিধায় বলা যায়, আরও বহুগুণ উন্নতির সম্ভাবনা ছিল। যেটা করতে পারেনি বেশিরভাগ-সময়-ক্ষমতায়-থাকা কংগ্রেস। এই বস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
যদি ভোট-পূর্ববর্তী সমীক্ষাগুলিকে সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে এবারের হাওয়া বিজেপির দিকে। বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। যদি কোনো কারণে বদলে যায় সমীক্ষার হিসাব এবং জোট রাজনীতির অঙ্কে দিল্লির দখল নেয় কংগ্রেস, তবে প্রধানমন্ত্রী হবার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন রাহুল গান্ধী। তবে একথা হলফ করে বলা য়ায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে অবশ্যই বসবেন একজন নতুন মুখ।
আর এই নতুন মুখের কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আশা করে ভারতবাসী। যেটিকে ভারতবাসীর প্রথম আশা এবং একমাত্র আশাও বলা যেতে পারে, সেটি হোল এই রাজনৈতিক দলগুলির দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ।
নরেন্দ্র মোদী তার প্রতিশ্রুতিতে জানিয়েছেন, তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্তের দ্রুত বাস্তবায়নই করতে চান। বলাই বাহুল্য, ভারতের তরুণ ভোটারদের এই বিষয়টি যথেষ্ট আকর্ষণ করেছে।
একই রকম আশা রাহুল গান্ধীর কাছেও। শুধু ভারতের তরুণ প্রজন্ম নয়; ভারতের সব বয়েসের মানুষেরই তীব্র অনীহা আছে সরকারি লাল ফিতের ফাঁসে। ২০১৪ সালের জেটগতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া জীবনযাত্রায় সরকারি লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকার তীব্র বিরোধি ভারতের জনগণ।
তবে যদি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন মোদী, তার কাছে সবার আগে যে-দুটি চ্যালেঞ্জ আসবে সেগুলো হলো, প্রথমত অন্য দলগুলোর প্রতি সরকারের মনোভাব এবং তার গায়ে লেগে থাকা সাম্প্রদায়িক তকমা ঝেড়ে ফেলা।
মোদীর বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা তিনি সাম্প্রদায়িক। যদিও বিজেপির তরফে বারবার নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলা হয়, তবুও সাম্প্রদায়িক তকমা থেকে বিজেপি কখনই মুক্ত হতে পারেনি। এর প্রধান কারণ অবশ্যই বাবড়ি মজসিদ ভাঙার ঘটনা।
অপর দিকে বিগত দশ বছরে কমনওয়েলথ গেমস, টু জি কেলেঙ্কারি, কোলগেট কেলেঙ্কারির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল ড. মনমোহন সিং পরিচালিত ইউপিএ সরকার। লোকসভা নির্বাচনে জিতলেও এইসব দুর্নীতির অভিযোগ যে কংগ্রেসকে তাড়া করে বেড়াবে সেটা ভালোই জানেন রাহুল গান্ধী। আর এই দুর্নীতির জিনকে বোতলবন্দি করা তার কাছে হয়ে দাঁড়াবে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
গুজরাট মডেলকে সামনে রেখে প্রচার করেছেন মোদী। তিনি বারবার বলেছেন, গুজরাটে যে পদ্ধতিতে উন্নতি হয়েছে সেই পদ্ধতিতে উন্নয়ন করবেন তিনি গোটা দেশের। যদিও গুজরাট মডেল নিয়েও বিতর্ক আছে । তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, গুজরাট মডেল সফল, তাহলেও কিন্তু সাড়ে ৬ কোটি জনসংখ্যার গুজরাটে সহজেই যা করা সম্ভব, ১২৭ কোটি মানুষের দেশ ভারতে তা করা একেবারেই অন্য বিষয়। এটি নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় চ্যালেঞ্জ।
তার কাছে গোটা দেশের ভোটারদের প্রবল প্রত্যাশা। আর এই প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে প্রচারের কাজে ব্যবহার করছে বিজেপি। কিন্তু যদি বিজেপি সরকার গড়ে তবে এই প্রবল প্রত্যাশার চাপ তাদের বইতে হবে। আর সেই মত কাজ করতে না পারলে বিজেপি সম্পর্কে হতাশ হতে মানুষের খুব বেশি সময় লাগবে না।
ঠিক যেমন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সম্পর্কে মানুষের প্রবল আশার প্রতিফলন হয়েছিল ভোটে। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে সেই আশা পূরণ করতে না পারায় তৈরি হয়েছে চাপা ক্ষোভ। মানুষ যে পূর্ণিমার চাঁদের আশা করেছিল বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাকে ঝলসানো রুটি মনে হচ্ছে।
ঠিক তেমনই কংগ্রেসের ক্ষেত্রে ১০ বছর দেশ চালানোর ফলে মানুষের মনে জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক হতাশার বহিঃপ্রকাশের প্রভাব পড়বে ভোটে, একথা অনস্বীকার্য।
নরেন্দ্র মোদীর চতুর্থ চ্যালেঞ্জটি আরও কিছুটা কঠিন। চতুর্থ চ্যালেঞ্জটি আসবে বিজেপি সরকার গঠনের পরেই। কোন বিশেষ দপ্তর কোন নেতার হাতে দেবেন মোদী। অর্থাৎ ক্ষমতার বিন্যাস। আর গণতন্ত্রে এই ক্ষমতার বিন্যাসের উপর অনেকটাই নির্ভর করে সরকারের সাফল্য।
বিশেষ করে দেশের সুরক্ষা, বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্প, বিদ্যুৎ এবং পরিকাঠামো সংক্রান্ত দপ্তরগুলিতে যোগ্য নেতাদের নিয়োগ করতে হবে নরেন্দ্র মোদীকে।
শুধু তাই নয়, যে লাল ফিতের ফাঁস আর দুর্নীতির জিন তাড়া করে বেড়িয়েছে কংগ্রেস সরকারকে সেই সমস্যার সমাধান করতে সৎ আধিকারিকদের প্রশাসনের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে হবে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে।
ভারতের প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রথম সারির আধিকারিক নিয়োগ নিয়ে প্রায় সব রাজ্যেই বিরোধী দলগুলি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী যিনিই হোন না কেন তাকে এই বিষয়ে নজর দিতে হবে। কারণ পক্ষপাতদুষ্ট আধিকারিকদের ফলে অনেকটাই থমকে থাকে উন্নয়নের কাজ। এই বিষয়টি ভারতীয় জনগণের কাছে অন্যতম একটি বিরক্তির বিষয়।
আরও একটি বিষয় ভারতের আগামী প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখতে হবে সরকারি আধিকারিক এবং মন্ত্রীরা জনগণের সেবার জন্য নিয়োজিত। তারা কখনই জনগণের শাসক নয়। তাই আধিকারিক এবং নেতা-মন্ত্রীদের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবকে কোনোভাবেই প্রশয় দেওয়া চলবে না। প্রশাসনের প্রথম সারির মানুষদের মনোভাব সামন্ততান্ত্রিক হলে উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও প্রান্তিক মানুষদের কাছে পৌঁছায় না। আর প্রান্তিক মানুষদের সমস্যাও পৌঁছায় না সরকারের কান পর্যন্ত।
এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন সভায় বলা নরেন্দ্র মোদীর একটি ভাষণের লাইন খুবই উল্লেখযোগ্য। সরকারি আধিকারিক এবং মন্ত্রীদের আদর্শ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে মোদী বলেছেন, তাদের হতে হবে কর্মযোগী, কর্মচারী নয়। কিন্তু একথা রাহুল গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদী সকলেই জানেন ভোটের ময়দানি ভাষণে কাব্যিকভাবে নিজের যোগ্যতার কথা ভোটারদের কাছে বলা যতটা সহজ, তটটাই কঠিন কাজে করে দেখান।
গোটা ভারতে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে। যদিও অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, প্রাধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বিশ্বের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করে মুদ্রাস্ফীতি যতই বিশ্ব অর্থনীতির কারণে বলে বোঝাতে চেষ্টা করুন না কেন, মানতে রাজি নয় বিরোধী দলগুলি।
তাদের দাবি বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীতে ভাগ করে নয় দেশের সমস্ত মানুষকে সস্তা দামে খাদ্যশস্য দিতে হবে। এই প্রসঙ্গে গোটা দেশে ‘রেশনিং’ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার অভিযোগ করে বামেরা বহু দিন ধরই সরব হয়েছে। আগামী দিনে মুদ্রাস্ফীতিকে রোধ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে ভারতের নতুন প্রধান মন্ত্রীর।
এর সঙ্গে আরও কয়েকটি অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কড়া পরিস্থিতির সামাল দিতে হবে ভারতের নতুন সরকার তথা তার প্রধানমন্ত্রীকে। এর মধ্যে আছে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকির বোঝা।
অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভর্তুকির বোঝা সরকারের কোষাগারকে প্রতি মুহূর্তে চাপের মধ্যে ফেলছে। আবার বহু জরুরি ক্ষত্রে ভর্তুকির অভাবে সমস্যায় মধ্যে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এই দুই বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে বেশ কিছুটা নাকাল হতে হবে ভারতের আগামী সরকারকে।
অনেক ক্ষেত্রেই ভর্তুকির একটা বিরাট অংশ গরিব মানুষদের হাতে গিয়ে পৌঁছায় না। এর একটি বড় কারণ দুর্নীতি। এই সমস্যাকে সমাধান করতে ভারতের আগামী প্রধানমন্ত্রী কি ব্যবস্থা নেন সেটাই দেখার। এই বিষয়টিও তার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে এটা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
শুধুমাত্র দিল্লিতে বসে বা দিল্লিকে কেন্দ্র করে গোটা ভারতের উন্নতি করা সম্ভব নয়, এটা খুব ভালোভাবেই জানেন মোদী এবং রাহুল। তাই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের উপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
দেখা গেছে ভারতের যেসব রাজ্যে বিরোধী দলগুলি সরকার চালায় তারা বারে বারে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ আনে। যেমন আনছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বিষয়গুলিকে মিটিয়ে সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা করা এবং সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যথেষ্ট কঠিন বিষয়ে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গ্রাম এবং শহরের মধ্যে ভারসাম্য রেখে উন্নয়ন করাটাও একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। উন্নত রাস্তাঘাট এবং পরিষেবা দিয়ে গ্রাম এবং শহরের ব্যবধান কমিয়ে না আনতে পারলে প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামে বসবাসকারী ভারতীয়ের বাস্তব উন্নতি করা কখনই সম্ভব নয়।
চীনে যেভাবে “বিশেষ শহর” পরিকল্পনা করে একটি শহরের মোট ব্যয় ঐ শহরের মধ্যে থেকেই তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই ভারতের শহরগুলির মোট খরচের জন্য গ্রামগুলির উপর নির্ভর না করে শহরগুলির খরচ শহরগুলি থেকে তুলে নেবার বিষয়টিও ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
সবশেষে বলেতে হয়, বৈদেশিক নিতি। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে পারস্পারিক বাণিজ্যের প্রসার না ঘটাতে পারলে থমকে যাবে উন্নয়ন। তাই ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা করার বিষয়টিকেও খুবই সতর্কভাবে পরিচালনা করতে হবে।
ভোটের প্রচারের সময় মোদী যেমন তার গুজরাটে সাফল্যকে কাব্যিকভাবে তুলে ধরছেন, ঠিক তেমনি রেল স্টেশনের কুলি থেকে শুরু করে ভূমিহীন কৃষকের দরজায় গিয়ে নিজের এবং কংগ্রেসের যোগ্যতার কথা তুলে ধরছেন রাহুল গান্ধী। তবে প্রচারের এই কাব্যিক রূপ কতোটা প্রশাসনিক স্তরে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী আগামী ৫ বছর, সেটার পরীক্ষাই নেবে ভারতের জনগণ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩১ ঘণ্টা, ১১ মে , ২০১৪