ঢাকা: জাতীয় নিরাপত্তায় দেশের গোয়েন্দা বিভাগে অসাধারণ কীর্তির স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি। তবু অজ্ঞাত কারণে প্রায় একদশক অনেকটা অন্তরালে থেকে গেছেন।
শেষ পর্যন্ত গুঞ্জন সত্যি হলো, শুক্রবার ভারতের নয়া সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তরালের সেই নায়ক অজিত কুমার দোবালকে।
নয়া সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নতুনভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করা দোবাল গত নয় বছর ধরে বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের (ভিআইএফ) প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য স্বীকৃত ভিআইএফ অবশ্য অজিতের কারণে মোদীর দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবেও পরিচিত।
বিশ্ব গোয়েন্দা জগতের ‘লিজেন্ড’ খ্যাত ৬৯ বছর বয়সী দোবাল ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ভারতের ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক পদ থেকে অবসর নেন।
তবে, অবসরের আগে নিজের অসাধারণ সব কীর্তির জন্য খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যান তিনি।
দোবালের অসাধারণ গোয়েন্দা কার্যক্রমের সফলতার গল্প বলতে গেলে প্রথমেই আসবে ‘অপারেশন এমএনএফ’র কথা।
মধ্যম সারির গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মিজোরাম রাজ্যে গড়ে ওঠা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট’র (এমএনএফ) মধ্যে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনুপ্রবেশ করেন তিনি। এরপর ওই সংগঠনটির পিঠ ভেঙে দিয়ে সাত কমান্ডারের মধ্যে ছয়জনকে নিয়েই বের হয়ে আসেন তিনি। তার এ বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপের ফলে সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছাতে বাধ্য হন এমএনএফ’র প্রধান লালদেঙ্গা।
২০ বছর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পর দোবালেরই কৃতিত্বে ১৯৮৬ সালে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করে এমএনএফ।
১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে পাঞ্জাবের অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির থেকে বিদ্রোহীদের সরিয়ে নিতে পাকিস্তানি এজেন্ট সেজে সেখানে ঢুকে পড়ে খালিস্তান বিদ্রোহীদের (পাকিস্তানপন্থি বলে খ্যাত) সঙ্গে আলাপ করে দ্রুত কেটে পড়েন দোবাল। এর কয়েকমাস পরই দোবালের আঁকা ছকে ১৯৮৮ সালে ‘অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার’ চালিয়ে বিদ্রোহীদের পাকড়াও করতে সমর্থ হয় নিরাপত্তা বাহিনী।
স্বর্ণ মন্দির অভিযানে দুঃসাহসিক ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে দোবালকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘কীর্তি চক্র’-এ ভূষিত করা হয়।
কেরালা ক্যাডারের ১৯৬৮তম ব্যাচের আইপিএস কর্মকর্তা দোবাল চির বৈরী পাকিস্তানেও বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট পালন করেন।
শুধু তাই নয়, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা কুক্বেই পাড়ে’র মতো খ্যাতনামা জঙ্গিদের প্রলুব্ধ করে নিয়ে আসেন এবং তাদেরই উল্টো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামান। যদিও দোবালের এ নীতি নিয়ে কিছুটা সমালোচনা হয়েছে, তথাপি এ নীতির কারণে কাশ্মীরে সশস্ত্র আন্দোলন অনেকটা কমানো গেছে বলে প্রশংসিতও হয়েছেন তিনি।
৩৭ বছরের চ্যালেঞ্জিং ক্যারিয়ারে দোবালের সবচেয়ে বড় কীর্তি ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় জঙ্গিদের সঙ্গে সমঝোতায় সরকারের পক্ষে নের্তৃত্ব দেওয়া।
১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ড থেকে দিল্লিগামী ফ্লাইট আইসি-৮১৪ আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিরা ছিনতাই করে নিয়ে গেলে সরকারের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
তবে, কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজটি উদ্ধারে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনায় ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দোবাল।
এ ভূমিকার জন্যও বেশ প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি।
অবসর পরবর্তী সময়ে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের নির্বাচনী প্রচারণায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। কিন্তু ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট জয়লাভ করলে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় দোবালের কোনো ভূমিকা রাখার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতে সরকার গঠন করা কংগ্রেস সরকারের গত এক দশকের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিব শঙ্কর মেনন। অবশ্য, কূটনৈতিক ক্যারিয়ারের মেননের সঙ্গে দোবালের পার্থক্য মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দাবৃত্তি করে আসা। এজন্য নিজের পূর্বসুরীর চেয়ে তিনি ভিন্ন কিছু করবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
অনেক অপেক্ষার পর সেই সুযোগ পেলেন দোবাল। সুযোগ পেলেন দেশের নিরাপত্তা নীতিতে প্রধান ভূমিকা রাখার।
প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তার সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দোবাল- দু’জনকেই দেশটির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সামর্থে বিশ্বাসী এবং কট্টর সন্ত্রাসবিরোধী বলে মনে করা হয়। এখন ভারতের পাশাপাশি পুরো বিশ্ববাসীই নজর রাখছেন, মোদীর ঘনিষ্ঠ দোবাল অন্তরাল থেকে ফিরে কী করেন দেশের জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ০২০১ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৪