কলকাতা: ঈদের চাঁদের অপেক্ষায় আকাশের দিকে চেয়ে আছে কলকাতাবাসী। এই সময়ে গোটা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের সঙ্গে কলকাতাতেও চলছে ঈদের শেষ মুহূর্তের বেচাকেনা।
ক্যালেন্ডারের হিসেবে রোববার ছুটির দিন কলকাতায়। কিন্তু এই রোববারের কলকাতা ছিল বছরের অন্যান্য রোববারের চাইতে একেবারেই ভিন্ন। আর বাধ সাধেনি বৃষ্টিও। ঈদের আগের শেষ রোববার ছিল কলকাতার ব্যস্ততম একটি দিন। গোটা কলকাতা ছিল এদিন ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত।
শেষ মুহূর্তের কলকাতায় ঈদের বাজারে হাজির হয়েছিল বাংলানিউজ। বাজারে গিয়ে দেখা গেল, দোকানে দোকানে ঘুরে নিজের পছন্দের জিনিসটি কেনার জন্য কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজির হয়েছেন প্রচুর মানুষ।
শুধু কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত বললে সঠিক বলা হবে না, বাজারে আসা ক্রেতারা জানালেন, তাদের অনেকেই এসেছেন কলকাতার আশপাশের মফস্বল শহর থেকে। অনেকেই এসেছেন কলকাতা-লাগোয়া জেলা এমনকি উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো থেকেও। উদ্দেশ্য একটাই, পছন্দের জিনিসটিকে ব্যাগবন্দি করা।
শুধু যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা নয়, ক্রেতা এবং দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল রাজ্যের বাইরে এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকেও বেশ কিছু ক্রেতা হাজির হয়েছেন ঈদের বাজার করতে।
বাংলাদেশ থেকে আসা ক্রেতারা জানালেন, শুধু ঈদের বাজার করতেই তাদের কলকাতায় আসা। কিন্তু শুধু কেনাকাটা করতে কেন কলকাতায় আসা? জানতে চাইলে তারা জানালেন, মূল কারণ দামের পার্থক্য।
কলকাতার ঈদের কেনাকাটার জন্য বিখ্যাত বাজারগুলোর একটু বর্ণনা করা দরকার। ভিড়ের নিরিখে ঈদের বাজারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই নাম আসবে কলকাতার হগ সাহেবের বাজারের। এই বাজারের পরিচিত নাম ‘নিউ মার্কেট’। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট এলাকার এই বাজার ভিড়ের নিরিখে সব থেকে এগিয়ে।
এর পরেই বিখ্যাত চিতপুর বা কলুটলা বাজার। কলকাতার নাখোদা মসজিদের পাশে এই বাজারেও ঈদের কেনাকাটার যথেষ্ট ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া আছে হাতিবাগান, খিদিরপুর এবং গরিয়াহাট বাজার।
যথেষ্ট ভিড় বললে বোধহয় ভিড়ের সঠিক চিত্রটা তুলে ধরা হয় না। চিতপুর বাজারে দুপুরের আগে পৌঁছে বাজারের শুরু থেকে নাখোদা মসজিদের কাছে পৌঁছতে পায়ে হাঁটা ১০ মিনিটের রাস্তা যেতে সময় লাগলো প্রায় আধা ঘণ্টা।
রাস্তায় ভিড়ের চাপে গাড়ির গতি একমাত্র শামুকের গতির সঙ্গে তুলনীয়। রাস্তায় মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে গেছে ট্রাম। একেবারে ঢাকার কাজের দিনের ব্যস্ততম রাস্তার মতো অনেকটাই।
যতদূর দেখা যায়, শুধুই মানুষের মাথা। দোকানে দোকানে দরাদরি, কেনাকাটা আর দুইহাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে কোনোরকমে ধাক্কা সামলে পরিবার-বন্ধুদের নিয়ে পরের দোকানে প্রবেশের চেষ্টার একটা কোলাজ ধরা পড়ল চিতপুর বাজারে।
দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বড়দের পাঞ্জাবি, শেরওয়ানির চাহিদা সব থেকে বেশি। সাদা পাঞ্জাবি এবং শেরওয়ানির চাহিদা প্রতিবারের ঈদের মতোই আকাশচুম্বী। শেরওয়ানির দাম ২ হাজার থেকে ১৫ হাজার রুপির মধ্যে। তবে বিশেষ কিছু শেরওয়ানি আছে যেগুলির দাম আরও বেশি।
তবে ছোটদের শেরওয়ানি শুরু হয়েছে ৪০০ রুপি থেকে। আছে ৮০০, ১ হাজার এবং ৫ হাজার রুপি দামের শেরওয়ানিও। চাহিদা আছে আদ্দি পাঞ্জাবির। মহিলাদের পোশাকে ব্যাপক চাহিদা বিভিন্ন ধরনের চুড়িদারের সঙ্গে কাজ করা বোরখার।
চিতপুর বাজার বিখ্যাত বিশেষ দুটি কারণে- একটি টুপি এবং অপরটি লুঙ্গি। বাংলাদেশ এবং তুর্কি থেকে মূলত টুপি এসেছে বাজারে। হরেক নকশার হরেক মাপের। দাম ৪০ রুপি থেকে ২০০ রুপি পর্যন্ত। কথা বলে জানা গেল, সাদা তুর্কি বা চাঁদ-সিতারা টুপি যুবকদের প্রথম পছন্দ।
চাহিদা আছে আফগানিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা বিশেষ নকশাকাটা টুপিরও। জরির কাজের এবং বরকতি টুপির বিশেষ চাহিদা রয়েছে। কয়েকজন ক্রেতা জানালেন, তারা একাধিক টুপি কিনে রাখছেন।
বিক্রেতারা জনালেন, রাত একটা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখছেন ক্রেতাদের চাপে। তবে গত বছরের তুলনায় এই বছরে ব্যবসা কিছুটা কম বলেই তারা মনে করছেন। এর কারণ মূল্যবৃদ্ধি বলে জানালেন ক্রেতারা।
কলকাতার কেনাকাটার মানচিত্রে নিউ মার্কেট বিশেষ তারকা চিহ্নে চিহ্নিত থাকে। নিউ মার্কেটের ইতিহাসটি অনেকেরই অজানা।
তাই পাঠকদের অনুমতি নিয়ে আগে সামান্য ইতিহাসের অলিন্দে পায়চারি করে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন কলকাতার বাজারের মধ্যে নিউমার্কেটের বিশেষ তারকা চিহ্নটি সংযোজিত থাকে।
সময়টা ১৮৫০, ব্রিটিশ শাসকরা কলকাতার বুকে জাঁকিয়ে বসেছেন। তারা লক্ষ করলেন, যত গণ্ডগোল বাজার করতে গিয়ে। সেখানে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই ঝগড়ায় জড়িয়ে পরছেন ব্রিটিশ সৈন্যরা। আর সৈন্য হলে কী হবে ঝগড়া যখন হাতাহাতিতে গড়াচ্ছে তখন সমষ্টিগত শক্তির কাছে পরাভূত হচ্ছে ব্যক্তিগত সামরিক কলাকৌশল। তাই তারা ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য একটি আলাদা বাজার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
বাজার তৈরি হল ১৮৭০ সালে আর তার ১৮ বছর বাদে কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান সুয়ার্ট হগ সাহেবের নামে বাজারের নামকরণ করা হল- স্টুয়ার্ড হগ মার্কেট। তৎকালীন কলকাতাবাসী যাকে বলত ‘হগ সাহেবার বাজার’।
বাজারের পোশাকি নাম ‘সুয়ার্ট হগ মার্কেট’ হলেও মুখে মুখে চালু হওয়া ‘নিউ মার্কেট’ নামটিই জনপ্রিয় হয়ে থাকল। ‘নিউ মার্কেট’ এর গঠনে আজও ইউরোপীয় গঠনশৈলীর ছাপ সযন্তে রক্ষা করা হয়েছে।
‘নিউ মার্কেট’ এর ভিতর এবং তার বাইরে ঈদের বাজারের জন্য কয়েক হাজার দোকান বসে। ভিতরের দোকানগুলি স্থায়ী কাঠামোর হলেও কলকাতার আইন অনুযায়ী রাস্তার উপরের দোকানগুলি কোন স্থায়ী কাঠামোর হয় না।
পার্ক স্ট্রীট এলাকার বাজারে হাজির হয়ে দেখা গেল, কেনাকাটার জন্য অন্তত লক্ষাধিক মানুষের ভিড়। দলে দলে মানুষ আসছেন আবার দলে দলে মানুষ বেড়িয়ে যাচ্ছেন বাজার থেকে। ধাক্কা বাঁচিয়ে সেখানে ছবি তোলা এক দুরূহ কাজ ।
কী নেই সেখানে? পুরুষ, মহিলা থেকে শুরু করে শিশুদের নানা রকমের পোশাক। পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি থেকে শুরু করে নামী-দামী ব্রান্ডের শার্ট, জিন্স, টি শার্ট, জুতো সব কিছুই। মহিলাদের চুড়িদার, শাড়ি, ঘাগরা থেকে শুরু করে আধুনিক সমস্ত পোশাকের চাহিদাই তুঙ্গে।
বাংলাদেশে এবার জনপ্রিয় হয়েছে ‘পাখি’ পোশাক। কিন্তু কলকাতার বাজারে বহু দোকানে খোঁজ করে জানা গেল ‘পাখির’ কোন চাহিদা নেই কলকাতায়।
শুধু পোশাক কেন, প্রসাধনী থেকে শুরু করে চুড়ি, গহনা সমস্ত দোকানেই তিল ধারনের জায়গা নেই। তবে কলকাতায় শুধু ইসলাম ধর্মের মানুষরা নন, এই কেনাকাটায় হাজির অন্যান্য ধর্মের মানুষরাও।
তার প্রধান কারণ ঈদের বাজারের সঙ্গে অনেকেই সেরে নিচ্ছেন শারদ উৎসবের কেনাকাটাও। এছাড়া ঈদে উপহার দেওয়ার যে রীতি চালু আছে তা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে পালন করা হয়।
ক্রেতারা আরও জানালেন, ঈদের সময় বাজারে আসে বেশ কিছু নতুন ধরনের ডিজাইন। সেগুলি সংগ্রহ করাও তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- ঈদের বাজারে ভিড় নেই কলকাতার নামিদামি শপিং মলগুলিতে। ক্রেতারা জানালেন, শপিং মলে পোশাকের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে তাই তাদের প্রিয় চিরন্তন ‘নিউ মার্কেট’।
ঈদের বাজার দেখতে দেখতেই কলকাতার আকাশে নেমে এলো সন্ধ্যা। ইফতারের সময় হয়ে এল। কিছুক্ষণের জন্য শান্ত গোটা ‘নিউ মার্কেট’ এলাকা। হঠাৎ করেই উধাও কয়েক মিনিট আগের হইচই। শুরু হলো ইফতার। দোকানের দরজা সাময়িকভাবে বন্ধ।
যে যার মতো শুরু করলেন ইফতার। এবার আমাদের ফেরার পালা। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবার শুরু হবে উৎসবের কেনাকাটা, বলা যেতেই পারে ‘কেনাকাটার উৎসব’।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৪