ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সংকট নেই, নানা অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে চালের দাম 

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪
সংকট নেই, নানা অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে চালের দাম 

ঢাকা: কোনো রকম সংকট না থাকা সত্ত্বেও বেড়েই চলেছে চালের দাম। গত দেড় মাসে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি চালের দাম ২ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

দেশের ১৪ জেলায় বন্যার কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার পাশাপাশি ত্রাণ কাজে বিপুল পরিমাণ চাল লাগছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে এ অজুহাতে ৫০ কেজির প্রতিবস্তা চালে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একইসঙ্গে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলোতে ধান ও চালের মজুত গড়ে তুলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে চালের দাম দেশের বাজারের চেয়ে বেশি। ফলে আমদানির সম্ভাবনাও কম। অক্টোবর মাস পর্যন্ত চালের বাজারে অস্থিরতা থাকতে পারে। তবে নভেম্বরে আমন কাটা শুরু হলে চালের দাম কমতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।  

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত মজুত থাকার পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বন্যা, ত্রাণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে চালের দাম। একইসঙ্গে মোকামগুলোতে ধান ও চালের মজুত গড়ে তুলে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার মতো অভিযোগও করেছেন।

বিশেষ করে ধান উৎপাদন এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজশাহী, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়ার মোকামে ধান-চাল মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট প্রথা ভাঙতে চাল আমদানির এলসি উন্মুক্ত করার দাবি ব্যবসায়ীদের।

শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজারের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতিকেজি দেশি বাসমতি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭৫ টাকা। নাজিরশাইল চাল ৬৮ থেকে ৮০ টাকা, মাঝারি মানের বিআর ২৮, ২৯ নম্বর চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, মোটা স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫৭ টাকা ও হাইব্রিড মোটা ৫৪ টাকা।  

গত জুলাই মাসেও খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি বাসমতি ৮৪ থেকে ৯০ টাকা, মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৮ টাকা। নাজিরশাইল চাল ৬৫ থেকে ৭৮ টাকা, মাঝারি মানের বিআর ২৮, ২৯ নম্বর চাল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা, মোটা স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫৪ টাকা ও হাইব্রিড মোটা ৪৮ টাকা।  

এদিকে পাইকারি বাজারে বর্তমানে চিকন চাল প্রতিকেজি মিনিকেট মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭২ টাকা। নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭৪ টাকা। দেশি বাসমতি চাল প্রতিকেজি ৮৫ থেকে ৮৮ টাকা। মাঝারি মানের প্রতিকেজি বিআর ২৮ নম্বর প্রতিকেজি চাল ৫৭ টাকা। বিআর ২৯ নম্বর ৫৮ টাকা। পাইজাম প্রতিকেজি ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। মোটা চাল গুটি স্বর্ণা চাল মানভেদে ৫৪ টাকা, হাইব্রিড ধানের চাল (গুটি) বা সবচেয়ে মোটা চালের দাম কেজি ৪৯ টাকা।  

অথচ গত জুলাই মাসেও পাইকারি বাজারে চিকন চাল প্রতিকেজি মিনিকেট মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৫৯ থেকে ৬৫ টাকা। নাজিরশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৬২ থেকে ৭৪ টাকা। দেশি বাসমতি চাল প্রতিকেজি ৮০ থেকে ৮৪ টাকা। মাঝারি মানের বিআর ২৮ নম্বর প্রতিকেজি চাল ৫১ থেকে ৫৩ টাকা। বিআর ২৯ নম্বর ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। পাইজাম প্রতিকেজি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা। মোটা চাল প্রতিকেজি গুটিস্বর্ণা চাল মানভেদে ৪৯ থেকে ৫১ টাকা। হাইব্রিড ধানের চাল (গুটি) বা সবচেয়ে মোটা চালের দাম কেজিতে ৪৬ টাকা।  

এদিকে মার্কিন কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট, আগস্ট–২০২৪’ শীর্ষক বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১৪ জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। প্রতিকেজি চালে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে সরকারি গুদামে চালের মজুতও গত বছরের তুলনায় কম রয়েছে। বিশ্ব বাজারে চালের দাম বেশি থাকায় এ মুহূর্তে চাল আমদানির সম্ভাবনাও কম। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে চালের বাজার কিছুটা অস্বাভাবিক থাকবে। তবে নভেম্বরে দাম কিছুটা কমতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

ইউএসডিএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে প্রায় এক মাস বিভিন্ন খাদ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব চালের বাজারেও পড়েছে। তবে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্দোলনের প্রভাব পড়েনি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশে বছরে মোট চালের চাহিদা রয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টনের বেশি। কিন্তু বন্যার কারণে এ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চালের উৎপাদন ৩ শতাংশ কমতে পারে। এ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৮ লাখ টন হতে পারে। ধান হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের চেয়ে সাড়ে ৩ শতাংশ কম।

এ বিষয়ে পুরান ঢাকার বাবুবাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মেসার্স রশিদ রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আবদুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, আগস্টে ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকেই চালের দাম বাড়তে থাকে। এরপর দেশের ১৪ জেলায় হঠাৎ বন্যা ও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়ায় দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে সব ধরনের চালের দাম মানভেদে কেজিতে ২ টাকা থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে হঠাৎ বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।  

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে কোনো চাল আমদানি হচ্ছে না। এরপর দেশের ১৪ জেলায় বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাড়তি সুবিধা নিতে ধান-চাল মজুত করে বাজারে সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। মোকাম মালিক ও মিলাররা আগের চাহিদাপত্র অনুযায়ী চাল দিতে অস্বীকৃতি জানালেও বাড়তি দাম পেলেই গুদামগুলোতে চালবাহী ট্রাক পাঠাচ্ছে। এজন্য চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে এলসি খুলে রাখা যেতে পারে। এতে করে দেশে চালের সংকট দেখা দিলে বা দাম বেড়ে গেলে বাইরে থেকে সহজেই চাল আমদানি করা যাবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে মনিটরিং। তা না হলে লাগামহীন হয়ে পড়তে পারে চালের বাজার।

বাবুবাজারের সেসার্স হাজি রাইস এজেন্সির মালিক মো. জিয়াউল হক বাংলানিউজকে বলেন, চালের দাম মানভেদে গত এক দেড় মাসে বস্তায় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। এখন শুধুমাত্র বন্যা, ত্রাণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত বাড়ানো হচ্ছে চালের দাম। একইসঙ্গে মোকামগুলোতে ধান ও চালের মজুত গড়ে তুলে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার মতো অভিযোগও করেছেন। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট প্রথা ভাঙতে চাল আমদানির এলসি উন্মুক্ত করার দাবি ব্যবসায়ীদের।

রায় সাহেব বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা মো. রাজু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বন্যা শুরুর পর থেকেই হঠাৎ আড়তে গিয়ে দেখি প্রতিবস্তা চালের দাম ১০০ থেকে ৩০০ টাকা করে বেড়েছে। শুনেছি অনেক ফসলের ক্ষতি হয়েছে, মজুত নষ্ট হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দামও বেশি। তাই মনে হচ্ছে দাম সহসা কমবে না। তবে নতুন আমন উঠলে পরে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করেন তিনি।  

সূত্রাপুর বাজারের মেসার্স আদনান অ্যান্ড আরাফাত ট্রেডার্সের মালিক মো. ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, চালের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আসলে বন্যায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। আর এ মুহূর্তে চাল আমদানি হচ্ছে না। বাজার স্থিতিশীল হতে কিছুটা সময় লাগবে।  

এদিকে খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন বলেছেন, এখন খাদ্যের (চাল ও গম) সরকারি মজুত ১৯ লাখ, এটা নিরাপদ পর্যায়ে আছে। তাই বলা যায়, এ মুহূর্তে দেশে খাদ্যের কোনো সংকট নেই, সরবরাহ পরিস্থিতির ভালো আছে। ফলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা আপদকালীন মজুত ধরেছি ১৩ লাখ টন, এরপর এ সংগ্রহ মৌসুমে এখন পর্যন্ত আর ২ লাখ টন হওয়ার কথা। সেখানে আমাদের মজুত অনেক বেশি আছে।

তিনি বলেন, শুধু সরকারি মজুত নয়, বেসরকারি ১৫০০ মিলে মজুত সন্তোষজনক বলে আমরা জেনেছি। কারণ গত বোরো মৌসুমে উৎপাদন ভালো হয়েছে। এছাড়া সরবরাহ মধ্যবর্তী সময়ে কিছুটা বিঘ্ন ছিল। কিন্তু এখন কোনো সমস্যা নেই।

চালের দাম প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব বলেন, আগস্টের ৫ তারিখের আগে পর্যন্ত চালের দাম ২-৫ টাকা বেড়েছিল। বাজারে ৪৯-৫১ টাকা সাধারণ মানের চাল পাওয়া যাচ্ছে। এটা স্বস্তিদায়ক।

উল্লেখ্য, গত ৩১ আগস্ট বোরো মৌসুমের সংগ্রহ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এ মৌসুমি ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, হয়েছে ১১ লাখ ২৫ হাজার টন। আতপ চালও এক লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৪ হাজার টন বেশি হয়েছে। তবে ধানের সংগ্রহ কম হয়েছে। এটা বরাবর কম হয়। গত বছর ৪০ শতাংশ হয়েছিল। সে তুলনায় ভালো হয়েছে। ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীত হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার টন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২৪
জিসিজি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।