ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

আর্থিক খাতে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না: অর্থ উপদেষ্টা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২৪
আর্থিক খাতে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না: অর্থ উপদেষ্টা

ঢাকা: স্বচ্ছতা না থাকলে অনেকেই পার পেয়ে যায়। তবে একটা মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করব আর্থিক খাতে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, বিগত সময়ে অনেক অপরাধ হয়েছে। আমরা কিছুদিনের জন্য এসেছি। সব কাজ করতে পারব না, তবে আমরা নিশ্চিত করব যাতে সবাই শাস্তি পায়। আমারা একটা মেসেজ দিতে চেষ্টা করছি, অন্যায় করে কেউ কিন্তু পার পাবেন না। তবে সেটা যথাযথ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আসবেন।

শনিবার (৫ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে ১১তম আইসিএসবি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাণিজ্য সচিব সেলিম উদ্দিন এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান, এফসিএমএ।  

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান এবং আইসিএসবি-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম নুরুল আলম এফসিএস।

প্রসঙ্গত, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এক্সিলেন্স, ২০২৩' অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আইসিএসবি।  

আইসিএসবির নির্ধারিত মান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কর্পোরেট গভর্নেন্স, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় কোম্পানিগুলোর প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্পোরেট গভর্নেন্স কোডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ভিত্তিতে ১৪টি শ্রেণিতে ৪১ কোম্পানিকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

পুরস্কার প্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান করেন প্রধান অতিথি ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গোল্ড, সিলভার ও ব্রোঞ্জ- এই তিনটি ক্যাটাগরিতে কোম্পানিগুলোকে পুরষ্কার প্রদান করা হয়। এবারের পুরস্কারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল 'প্রমোটিং গভর্নিং এক্সিলেন্স'।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের পুরো সুশাসন নিয়েই আমরা চিন্তিত। সরকারি কোনো অর্থই যেন অপচয় না হয়। অনেক অর্থের অপচয় হয়েছে, জবাবদিহিতা ছিল না। গত সময়ে অনেকেই অনেক কিছু করেছে। সবাইকে হিসাব দিতে হবে। পার্থিব পরকালে দুই জায়গাই হিসাব দিতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় রুল-প্লে করে বেসরকারি খাত। কোম্পানির ওপর যদি আস্থা না থাকে তাহলে বিদেশি বিনিয়োগের তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। এক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা অনেক। হিসাব প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত থাকেন তারা আসলে থার্ড আই হিসেবে কাজ করেন। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য কোম্পানি সেক্রেটারি বা অ্যাকাউন্ট্যান্টদের অনেক ভূমিকা রয়েছে।

তিনি বলেন, স্বচ্ছতা না থাকলে অনেকেই পার পেয়ে যায়। পরবর্তীতে যিনি দায়িত্বে আসেন তিনি ওউন করতে চান না। আমারা একটা মেসেজ দিতে চেষ্টা করছি, অন্যায় করে কেউ কিন্তু পার পাবেন না। তবে সেটা যথাযথ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আসবেন।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ কাজ করতে আগ্রহী, সবাইকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের যে জনশক্তি আছে তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতি দ্রুত সময় ঘুরে দাঁড়াবে। এরই মধ্যে অনেক সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক সম্পদ লুট করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যক্তিগত হোক আর দেশের সম্পদ হোক অপচয় বা দুর্নীতি করা যাবে না। এরই মধ্যে যেসব দুর্নীতি হয়েছে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এতদিন কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। অনেক অনিয়ম হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সবাইকে পরকালে হিসাব দিতে হবে, তবে পার্থিব হিসাব নিশ্চিত করা অডিটরদের দায়িত্ব। অডিট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

তিনি বলেন, বেসরকারি খাত এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। কারণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেশির ভাগই হয় বেসরকারি খাতে। আমাদেরকে আস্থা ধরে রাখতে হবে। ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, আমরা এর নেতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করছি। বিনিয়োগের পরিবেশ ধরে রাখতে হবে। যদি আস্থা না থাকে তাহলে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসবে না।

তিনি বলেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তিনটি অংশ থাকে। পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পর্ষদ এবং হিসাব ব্যবস্থাপনা বিভাগ বা অডিটর প্রতিষ্ঠান। অডিটররা যদি কোম্পানির সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কাছে তুলে ধরে তাহলে ওই প্রতিষ্ঠান সঠিক পথে পরিচালিত হবে। অডিটররা হলো প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় নয়ন। তাদেরকে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অনেক পরিচালক আছেন, যারা সামান্য যোগ-বিয়োগ পর্যন্ত জানেন না। তাই অডিটরদেরকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ পুরস্কার শুধু একটি স্মারক নয়; বরং আমাদের দেশে কর্পোরেট শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে একটি মাপকাঠি। আইসিএসবি গত কয়েক দশকে কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে একটি বিশ্বস্ত নাম হয়ে উঠেছে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের স্বীকৃতির ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে সুশাসন ও কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো বজায় রাখার বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগী হয়ে উঠছে। এ পুরস্কার প্রতিষ্ঠান ও তাদের নীতি-নির্ধারণী ও সুশাসনের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি করার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। আইসিএসবি কর্পোরেট নেতৃত্ব ও উন্নত কর্পোরেট সংস্কৃতি গড়ে তুলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি বিএসইসি-এর চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ তার বক্তব্যে বলেন, টেকসই পুঁজিবাজারের জন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড মেনে চলার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব, ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এ অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। আইসিএসবি ব্যবসায়িক খাতে চাটার্ড সেক্রেটারিদের ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতা বাড়ানোর জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করছে। আইসিএসবির সাফল্য কামনা করি। এ প্রতিষ্ঠান কর্পোরেট খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে, যা বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয় নিয়ে যাবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত যে তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে তার মধ্যে আইসিএসবি একটি। আমরা কোম্পানি আইন আপডেট করার জন্য কাজ করছি। আপনারা যদি কোনো সুপারিশ করেন তাহলে আমরা সেটা গুরুত্বসহকারে নেবো। নতুন বাংলাদেশ স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ বাংলাদেশ। আপনারা যদি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন তাহলে এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, একটি কোম্পানিতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কোম্পানি সচিবদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকর যোগাযোগ ও প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা উচ্চ পর্যায়ের পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং আচরণ বজায় রাখেন।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বর্তমান পরিবর্তনশীল ব্যবসা পরিবেশে সুশাসনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এ অ্যাওয়ার্ড কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক হতে এবং কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড তৈরিতে সহায়তা করছে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কর্পোরেট করদাতারা যদি তাদের দায়িত্ব পালন করেন তাহলে ছাত্র জনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কর্পোরেট কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। রাজস্ব আইনে সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে আমরা হাত দেব। অডিট রিপোর্টকে স্বচ্ছ করতে হবে। অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে পরিশোধ করতে চান না। যাতে কর ফাঁকি দেওয়া যায়।

তিনি বলেন, যেখানেই অনিয়ম দেখবো আমরা সোচ্চার হবো। আমরা চমৎকার বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি। যেখানেই অনিয়ম দেখবেন সেখানেই সোচ্চার হবো। আমাদের চোখ হবে, দুদকের চোখ।

আইসিএসবি-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান এম নুরুল আলম এফসিএস অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরে সুশাসন উৎসাহিত করা এবং একে সমুন্নত রাখা। আমরা সেসব কোম্পানি ও তাদের ব্যবস্থাপনাকে সম্মান জানাই যারা সুশাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিএসইসি প্রদত্ত কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড, কোম্পানি আইন-১৯৯৪ ও বৈশ্বিক সেরা অনুশীলনগুলো মেনে চলে।

আইসিএসবি-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কে এম মুশফিকুর রহমান, এফসিএস কর্পোরেট গভর্নেন্স অ্যাওয়ার্ডের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা তুলে ধরেন এবং বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ পুরস্কার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্পোরেট ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর অগ্রগতি অর্জনে অনুপ্রাণিত করবে।

পরিশেষে, আইসিএসবি-এর কাউন্সিল সদস্য মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া এফসিএস ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজন সরকারি কর্মকর্তা, পেশাজীবী, বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্যবসায়িক নেতা এবং বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরের গভর্নেন্সরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫,২০২৪
জিসিজি/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।