ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

লোকসানেও চাল বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা!

বেলাল হোসেন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫
লোকসানেও চাল বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা! বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শেরপুর (বগুড়া): চাতালে নিলে চালে লোকসান গুণতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আবার ব্যাপারি না থাকায় অনেক ব্যবসায়ী লোকসান দিয়েও চাল বিক্রি করতে পারছেন না।

ফলে চালে গুদাম ভরে যাচ্ছে। চাল বিক্রি করতে না পারায় ব্যবসায়ীর পকেট শূন্য হয়ে পড়ছে। কিন্তু ব্যাংকের সুদ থেমে নেই। বরং দিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তা বাড়ছে।

এদিকে চাল বিক্রি করতে না পারায় অধিকাংশ ব্যবসায়ীর পুরো চালান আটকে গেছে। ফলে তারা প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে চাতাল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এরপরও সামনে সুদিন আসবে- এমন আশায় বুক বেঁধে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এখনও অব্যাহত রেখেছেন।

কিন্তু এভাবে লোকসান দিয়ে কতোদিন ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে- এমন প্রশ্ন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ-হরতালের যাতাকলে পিষ্ট সব ধরনের ব্যবসায়ীর। তারা এ দশা থেকে মুক্তি পেতে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছেন।  

এদিকে ধানের দাম অব্যাহতভাবে পড়ে যাওয়ায় কৃষকরাও বুক চাপড়ে মরছেন। তবু বোরো চাষের প্রস্তুতি নিতে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। সব মিলিয়ে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত লোকসানের মুখে পড়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ব্যবসায়ী ও কৃষকরা।

পৌর শহরের ঐতিহ্যবাহী বারো দুয়ারিহাটে সরেজমিনে গেলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বাংলানিউজকে জানান, শেরপুর উপজেলাসহ উত্তরাঞ্চলের বাজারে বর্তমানে প্রতি মণ (সাড়ে ৩৭ কেজি) স্বর্ণা-৫ জাতের ধান ৭৩০-৭৪০ টাকা, গুটি স্বর্ণা ৬৫০-৬৬০ টাকা ও বিআর-৪৯ জাতের ধান ৮৫০-৮৬০ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে।

মেসার্স আদর্শ সেমি অটো রাইচ মিলের সত্ত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে জানান, স্বর্ণা-৫ জাতের ধান নওগাঁর ধামইরহাট, পোরশা, নজিপুর ও সাপাহারসহ বিভিন্ন মোকামে ৭৩০-৭৪০ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে।

এ ব্যবসায়ী জানান, প্রতি মণ ধান কিনে ঘরে আনতে আরও ৩০-৩৫ টাকা খরচ পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে পরিবহন ও শ্রমিক ব্যয়। এ ধান সিদ্ধ ও শুকানো বাবদ প্রতিমণে ব্যয় হয় ১৮-২০ টাকা। আর ভাঙাতে আরও ১০ টাকা খরচ পড়ে। সব মিলিয়ে ধান থেকে চাল উৎপাদন পর্যন্ত প্রতি মণ ধানে খরচ পড়ে ৭৮৮-৮০৫ টাকা।

অপরদিকে এ পরিমাণ (এক মণ) ধান থেকে বড়জোর ২৬-২৭ সের চাল পাওয়া সম্ভব। বর্তমান বাজারদর অনুসারে এ পরিমাণ চালের দাম সর্বোচ্চ ভালো হলে আসে ৭২৮-৭৬৯.৫ টাকা। আর চাল একটু নিম্নমানের হলে দাম আরও কম আসে। অর্থাৎ ‍ প্রতি মণ ধান থেকে চাল উৎপাদন শেষে তা বাজারে বিক্রি করলে বর্তমান বাজারদর অনুসারে একেকজন ব্যবসায়ীর ৩৫.৫-৬০ টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে।

তবে এখান থেকে রাইচ পলিশ, কুঁড়া, খুদ ও চিটা ধান বিক্রি করে কিছু বাড়তি টাকা আসে। তাই এখনও বেশ কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী চাতাল বন্ধ করেননি। কিন্তু এভাবে নিয়মিত লোকসান দিয়ে আর কতোদিন ব্যবসা চালু রাখা সম্ভব- এমন শঙ্কার কথাই জানালেন এই ব্যবসায়ী।

এসব কেবল তার একার কথা নয়, এ পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যবসায়ীর কথা। কেননা ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার আগেও স্থানীয় ও শস্যভাণ্ডার খ্যাত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন বাজারে প্রতিমণ স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ১১৮০-১২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে বলে আব্দুল লতিফ, জাহাঙ্গীর আলম, আইয়ুব আলীসহ একাধিক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান।

এছাড়া টানা অবরোধের মধ্যেই আবার থেমে থেমে হরতালের ঘোষণা আসছে। যা পুরো পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে।  
 
একাধিক চাতাল ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, এ উপজেলায় ২০০-৩০০শ’ মণ ধান ধরে এ রকম ২৪০-২৫০টি, ৪০০-৫০০শ’ মণ ধান ধরে এ রকম ৭০-৮০টি এবং ৫০-৬০ মণ হারে ধান শুকানো যায় এ রকম ১৫০০-২০০০টি চাতাল রয়েছে। এছাড়া এখানে শতাধিক সেমি অটো রাইচ মিল রয়েছে।

জাহাঙ্গীর আলম, আল মাহমুদ, আবু তালহা, শহিদুল ইসলামসহ একাধিক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, প্রতিটি বড় চাতালের বিপরীতে কমপক্ষে ১৪ জন ও ছোট চাতালে ৪জন করে শ্রমিক কাজ করেন।

তারা জানান, ২০ দলের টানা অবরোধ-হরতালের প্রভাবে চাল ও ধানের দাম পড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাপারিরা চাল কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বললেই চলে।

তাছাড়া একটি চাতাল নিয়মিত চালু রাখতে ৫-৬ চাতাল ধান মজুদের প্রয়োজনও রয়েছে। কিন্তু মোকামে ধান মিললেও চালের বাজার কমতির দিকে থাকায় লোকসানের সর্বোচ্চ ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। এছাড়া টানা অবরোধ-হরতালের কারণে পরিবহন ব্যয়ও আগের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। ফলে তাদের ব্যবসা বন্ধের পাশাপাশি পথে বসার উপক্রম হয়ে পড়ছে।

শেরপুর উপজেলা চাউলকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হামিদ বাংলানিউজকে জানান, সরকারি লাইসেন্সধারী ২৪৮ জন মিলারের মধ্যে অধিকাংশ মিলার একটানা দীর্ঘদিন ধরে চাল বিক্রি করতে পারছেন না। অন্যান্য চাল ব্যবসায়ীদের অবস্থাও একই রকম। আবার কেউ কেউ লোকসান দিয়ে চাল বিক্রি করতে চাইলেও অবরোধ-হরতালের কারণে ব্যাপারি পাচ্ছেন না। অথচ ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ গ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের লোকসানের পাশাপাশি নিয়মিত সুদ গুণতে হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।  

এই ব্যবসায়ী নেতা বাংলানিউজকে আরও জানান, এভাবে অব্যাহত লোকসানের মুখে ইতোমধ্যেই অনেক ব্যবসায়ী চাতাল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এক্ষেত্রে ছোট ব্যবসায়ী বেশি মার খাচ্ছেন। এ রকম অবস্থা অব্যাহত থাকলে অবশিষ্ট ব্যবসায়ীরা কী করবেন তা তারা ভেবে পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।