ঢাকা: তাঁর কাছে জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধানটি ছিলো মাত্র ১০ মিনিটের। কথা ছিলো সকাল সাড়ে ৮টায় যাবেন।
বিবিসি, আলজাজিরা, রয়টার্স, সিএনএন, এনডিটিভি, নিউইয়র্ক টাইমসসহ আন্তজার্তিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয় তার অভিজ্ঞতার বিবরণ। রানা প্লাজা ধসে পড়ার পূর্বাপর পরিস্থিতি নিয়ে বিবিসির ডুকুমেন্টারিতে জায়গা পায় তার সাক্ষাৎকার।
তিনি জাভেদ মোস্তফা। দৈনিক যুগান্তরের সাভারের স্টাফ রিপোর্টার। সাভার প্রেসক্লাবের সভাপতি। ধসে পড়ার আগের দিন ফাটলের খবর শুনে যিনি সবার আগে সেখানে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে রীতিমতো নাজেহাল হন তৈরি পোশাক মালিকদের নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে।
ঘটনার ২ বছর পরেও এখনই সব কিছুই জীবন্ত তার কাছে। নিমেষেই চোখের সামনেই ধসে পড়লো নয়তলা রানা প্লাজা ভবন। চারদিকে ধোয়ার কুণ্ডলি। চিৎকার। চেঁচামেচি। বাঁচাও আর্তি। আকস্মিক ঘটনায় বিস্ময়ে বিমূঢ় গোটা সাভার। হতবিহব্বল তিনিও ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে। দ্রুততার সাথে পাঠাতে থাকেন একের পর এক খবর। তারপর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর অনেকেই শরণাপন্ন হয় জাভেদ মোস্তফার। তার চোখেই বিশ্ব দেখতে থাকে ধসে পড়া রানা প্লাজার পূর্বাপর পরিস্থিতি।
কেমন ছিলো ওই সময়ের পরিস্থিতি? কিভাবেই বা নিজে আন্তজার্তিক গণমাধ্যমগুলোর কাছে তুলে ধরলেন নিজের অভিজ্ঞতা তা জানতেই বাংলানিউজ মুখোমুখি হয়েছিলো এই সংবাদকর্মীর কাছে।
তিনি বলছিলেন ‘২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, সকাল ১১টা। রানা প্লাজার সাড়ে ৩শত ফুট দুরে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে গিয়েছিলাম টাকা উত্তোলন করতে।
মোবাইল ফোনে একটি ফোন আসলো। এখনো মনে আছে, নামটি ছিলো শরিফের। রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় নিউ ওয়েভ বটমস নামের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক। জানালো ভাই রানা প্লাজায় আমাদের কারখানার মধ্যেই কয়েকটি পিলারে ফাটল। আমাদের জীবন ঝুঁকিতে। ভয়-ও লাগছে। অথচ এর মধ্যেই আমাদের কাজ করাচ্ছে। ফোন পেয়েই আমি ছুটে গেলাম। আমাকে ঢুকতে দেয়া হলো না। সিড়িতেই আসলো বাঁধা। এরই মধ্যেই সাংবাদিক হিসেবে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে কারখানায় ছুটি দেয়া হলো। আতঙ্কিত শ্রমিকরা দ্রুত নেমে গেল।
তবে আমার কৌতুহল ছিলো ফাটল পর্যন্ত পৌঁছানো। তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস কারখানার ফ্লোরে যেতেই নিরাপত্তাকর্মীদের একই কথা-সাংবাদিক –টাংবাদিক কেউই ঢুকতে পারবে না। কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে। আমাকে জোর করেই নামিয়ে দেয়া হলো। আমি ক্ষুব্ধ আর অপমানিত হলাম। বিষয়টি হজম করতেও কষ্ট হচ্ছিলো। সেখানে থেকেই ফোন দিলাম ইটিভির সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদা, এনটিভির সিনিয়র রিপোর্টার জাহিদুর রহমানসহ সহকর্মীদের। তারা আসলো। মনে জোর পেলাম।
সংবাদ সংগ্রহ করতে বাঁধা দেবার ঘটনায় মৃদু বচসা হচ্ছিলো সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে। এর মধ্যে রানা-ও এলো। এসেছিলো ভবনটির সম্প্রসারিত অংশের নকশাকার প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক। তাকে সঙ্গে নিয়েই আমরা তৃতীয় তলায় গেলাম। বেশকিছু ফাটল দেখলাম। ছবি তুললাম। এক পর্যায়ে ছবি তুলতে আবারো বাঁধা পেলাম। পরে ভবন মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা নিচে আমাদের তার কক্ষে নিয়ে গেলো।
তিনি আরও বলছিলেন, ‘বাড়ির নির্মাণ কাজ আমি নিজেও তদারকি করেছি। সেই হিসেবে ভবন নির্মাণ কাজের সাথে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা থাকায় ভবনটির ফাটল দেখে আমার কাছে বিষয়টি তখনই স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। দুইটি পিলারের রডগুলো ইট বালুর আস্তর ফুঁড়ে বাইরে যাওয়ায় ভাবছিলাম কখন না জানি দুর্ঘটনাই ঘটে বসে। '
এই পরিস্থিতির মধ্যে ভবনের একেবারে নিচতলায় রানার সুসজ্জিত অফিসে আমাদের নেয়া হলো। আমরা তার সাক্ষাতকার নিলাম। রানা সাফ জানালেন ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ নয়। যে অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে তা দ্রুত মেরামত করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে। রানা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো এরপর গাড়ি আনলে যেনো মার্কেটের বাইরে না রেখে যেন আন্ডার গ্রাউন্ডে রানার অফিসের সামনে পার্কিং করি।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে কর্ম পরিবেশ আমাদের ঘুরে দেখানো হবে এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে রানার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দৈনিক যুগান্তরে ফাটলের বেশকিছু ছবিসহ খবর পাঠালাম। ভবনটি যে কোন মূহৃর্তে ধসে পড়তে পারে- শ্রমিকদের এমন আশংকার কথা তুলে ধরা হয়েছিলো ওই রিপোর্টটিতে।
তবে রিপোর্টটি খুব বেশি গুরুত্ব পেলো না। পরদিন ২ কলামে দৈনিক যুগান্তরে দ্বিতীয় পাতায় খবরটি প্রকাশিত হলো তবে ফাটলের ছবি ছাড়াই। ভবনের ধসে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে ভবনের ক্রুটি, ব্যাংকের লোন ইত্যদি সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছিলো রিপোর্টিতে। খবর প্রকাশের দিন ভোরেই যুগান্তর দেখে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ দিতে চেয়েছিলেন সোহলে রানা। বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই আমাকে অনুরোধ করা হয় তার কার্যালয়ে যাবার। এবং ভবনটি যে নিরাপদ তা প্রত্যক্ষ করার।
তবে সকালে পত্রিকা হাতে পাওয়া দুই ঘণ্টার মধ্যেই ধসে পড়ে ৯ তলা রানা প্লাজার ভবনটি। সকালে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে কথা মতো রানা প্লাজার পথে রওনা করলাম। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা। রাস্তায় অপ্রত্যাশিত একজনের সাথে দেখা হওয়ায় সময় গড়িয়ে গেলো প্রায় ১০ মিনিট। পথেই বিকট শব্দ। তারপর ধুয়োর কুণ্ডলি। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধান আমার জীবন রক্ষা পেলো। ’
ভবনটি ধসে পড়ার পূর্বাপর মূহৃর্তে জাভেদ মোস্তফা নিজের ক্যামেরার ধারণ করেন বেশকিছু দুর্লভ ছবি। ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলার সুবাদে আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমের বহু সংবাদকর্মী তার শরণাপন্ন হন। তিনি নিজে-ও দোভাষী হিসেবে নিখোঁজ স্বজন আর উদ্ধার হওয়া আহত শ্রমিকদের আর্তি পৌঁছে দেন বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর কাছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে A report on Rana Plaza collapse:-Fact Finding Report শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিবিসি টেলিভিশনে প্রচারিত হয় তাঁর সাক্ষাতকার। বিবিসি টেলিভিশনের জন্যে একটি বিশেষ প্রামাণ্য চিত্রে-ও তার সাক্ষাৎতকার। লন্ডন থেকে অনুষ্ঠানটির পরিচালক সারা হায়েস ও প্রযোজক সারা হেমিল্টন এলেন।
প্রথমে রাজধানীর ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে প্রাথমিক সাক্ষাৎকার। অভিজ্ঞতার কথা শুনে তাঁরা সাভারে রানা প্লাজার সামনে জাভেদ মোস্তফাসহ রানা প্লাজার ধসে স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা ধারণ করলেন সেলুলয়েডের ফিতায়। যা কুইক সিলভার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে Clothes To Die শিরোনামে এক ঘণ্টার প্রামাণ্যচিত্র প্রচারিত হয় বিবিসি -৩ টেলিভিশনে।
এভাবেই সংবাদকর্মী হিসেবে জাভেদ মোস্তফার অভিজ্ঞতা বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের উপকরণে পরিণত হয়। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভিনদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে পরিণত হন অন্যতম ভাল মানুষ হিসেবে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বহুতল ভবন রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়। অন্তত দুই হাজার ৪৫৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। নিহত ও আহতদের অধিকাংশই ছিলেন পোশাক শ্রমিক।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৫
এনএস/