ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

অবৈধ সিগারেট আমদানি

বছরে রাজস্ব ক্ষতি ২৪৩ কোটি টাকা

রহমত উল্যাহ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৫
বছরে রাজস্ব ক্ষতি ২৪৩ কোটি টাকা ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: সীমান্তে অব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সিগারেটের মূল্য ও শুল্ক হারের পার্থক্য এবং আইনের ফাঁকে বাংলাদেশে বাড়ছে অবৈধ সিগারেট আমদানি।
 
সিগারেট কোম্পানিগুলো বিষয়টি অস্বীকার করলেও দেশে দেরাছে ঢুকছে অবৈধ বিদেশি সিগারেট।

ফলে ধূমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।

দি ইউনিয়ন নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অবৈধ সিগারেট আমদানিতে রাজস্ব ক্ষতি হয় প্রায় ২৪৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

দেশে প্রতিবছর খুচরা পর্যায়ে ১০ কোটি পিস (শলাকার) চোরাই সিগারেট বিক্রি হয়। এসব সিগারেট থেকে শুল্ক আদায় করতে পারলে প্রতিবছর ১৫০ কোটি টাকার রাজস্ব পাওয়া যেতো।

যদিও ক্ষতির পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি। এছাড়া বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এরপরও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
 
দি ইউনিয়নের গবেষণা মতে, বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে সিগারেটের অবৈধ মার্কেট শেয়ার ১২.১ শতাংশ। যেখানে উচ্চ আয়ের দেশে ৯.৮ শতাংশ।
 
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে সরকার প্রতিবছর রাজস্ব ক্ষতি হয় ২২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে সারাবিশ্বে রাজস্ব ক্ষতি ৪০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ, নেপাল, আফগানিস্তানসহ ৩৪টি দেশ নিম্ন এবং ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ ৫০টি দেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। অপরদিকে, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, কানাডা, যক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড উচ্চ আয়ের দেশ।

বিশ্ববাজারে মোট বিক্রিত সিগারেটের ১১.৬ শতাংশ (১০ শলাকায় ১টি) অবৈধ সিগারেট। বিদেশি সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য এসব দেশের ওপর পড়ছে।
 
গবেষণায় দেখা গেছে, অবৈধ সিগারেট রোধ করা গেলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচবে। যেখানে ১ লাখ ৩২ হাজার বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ। সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের অতিরিক্ত রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে ৩১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
 
১৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। তা বন্ধ করতে হলে এফসিটিসি ইলিসিটি ট্রেড বিষয়ক প্রটোকল অনুসরণ করতে হবে।
 
তামাকবিরোধী জোট প্রজ্ঞার ‘বাংলাদেশে তামাক পণ্যের অবৈধ বাণিজ্য’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বিক্রিত সিগারেটের ২৬ শতাংশ অবৈধ।
 
বাংলাদেশে প্রায় ৪০টি দেশ থেকে অবৈধ বিদেশি সিগারেট আমদানি করা হয়। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মায়ানমার। এরপর ইন্দোনেশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

উল্লেখযোগ্য অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে-সুইজারল্যান্ড, পাকিস্তান, জার্মানি, ভিয়েতনাম, জাপান, রাশিয়া, গ্রীস, দুবাই, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চায়না, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং কুয়েত।
 
ইজি, ইজিলাইট, ব্ল্যাক, প্রিনে প্রাইম, মোর, অরিস, পাইন, মার্লবোরো লাইটস, ট্রিপল ফাইভ, গুদাং গারাম, বেনসন হেজেজসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটে বাংলাদেশে আসে।

গবেষণা দেখা যায়, বাংলাদেশে স্থল, নৌ ও বিমান পথে অবৈধ সিগারেট আমদানি হয়। তবে, পার্শ্ববর্তী দেশে শুল্ক হার বেশি হওয়ায় স্থল পথে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিও হয়।
 
বিমান পথের মধ্যে ঢাকার হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধ সিগারেট আসে। নৌ পথের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর।
 
সিলেটের তামাবিল, সোনা মসজিদ, বেনাপোল, ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন অবৈধ বিদেশি সিগারেট আমদানি-রপ্তানি হয়।
 
গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ফরেনার (বিদেশি) শুল্ক মুক্ত সুবিধায় এক কার্টুন সিগারেট আনতে পারে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাগ ভর্তি সিগারেট নিয়ে এসে অবৈধ ব্যবসা করছে অনেকেই।
 
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্র জানায়, সিগারেট আমদানিতে শুল্ক প্রায় ৩৫০ শতাংশ। অনুমোদিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শর্ত সাপেক্ষে সিগারেট আমদানি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেই পথে সিগারেট আনছে না কেউই। সিগারেট কোম্পানিগুলোর মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সিগারেট আমদানিতে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে।
 
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর স্থল, নৌ ও বিমানবন্দর থেকে ২০০৪-১২ অর্থবছর পর্যন্ত ৩২৯৭ কার্টুন অবৈধ বিদেশি সিগারেট আটক করেছে।
 
২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬৪ লাখ টাকার ৩ হাজার ২৯৭ কার্টুন ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬ লাখ টাকার ১৮ হাজার ৪৩ কার্টুন অবৈধ সিগারেট আটক করা হয়েছে।
 
২০১৪-১৫ অর্থবছরে (জুলাই-এপ্রিল) ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকার ৯ হাজার ১৯৬ কার্টুন অবৈধ বিদেশি সিগারেট আটক করা হয়।
 
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বাংলানিউজকে বলেন, বিদেশি অবৈধ সিগারেট আটক ও শুল্ক আদায়ে আমরা তৎপর রয়েছি।
 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (ডব্লিউএইচও) টেকনিক্যাল কর্মকর্তা ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছে ডব্লিউএইচও।
 
তিনি বলেন, এবারের বিশ্ব ‍তামাক মুক্ত দিবসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভায় বিষয়টি তুলে ধরা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’র সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ফরেনার ও সিগারেট কোম্পানি অবৈধ সিগারেট আমদানির সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি) উপদেষ্টা ড. আবুল বারাকাত।

তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সিগারেটের আমদানি শুল্ক সমান ও অবৈধ সিগারেট আমদানির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে আমদানি হ্রাস পাবে।
 
বৃহৎ করদাতা ইউনিট’র (এলটিইউ) একজন যুগ্ম-কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, চোরাচালানের মাত্র এক শতাংশ সিগারেট আটক হয়। এতে বছরে প্রায় ৩শ’ কোটি রাজস্ব ক্ষতি হয়। বাজারে হরদমে অবৈধ বিদেশি সিগারেট বিক্রি হলেও ‘সীমাবদ্ধতার’ কারণে তা আটক করা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৫
আরইউ/টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।