ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সিন্ডিকেটের কব্জায় যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ফোন কলের বাজার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০০ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৫
সিন্ডিকেটের কব্জায় যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ফোন কলের বাজার

ঢাকা: সম্প্রতি বিদেশ থেকে আসা টেলিফোন কলের লাভজনক ব্যবসায় ‘নিয়মতান্ত্রিক’ সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি চক্র।

এতে তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা এই খাতটিতে সরকারের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় খেলাপী।

এই চক্রটির কাছে সরকারের তিন শতাধিক কোটি টাকার রেভিনিউ শেয়ার বাকি পড়েছে। তার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। উপরন্তু টেলিযোগাযোগ নিয়্ন্ত্রণ কমিশনও তাদের এই অন্যায় প্রতিষ্ঠার সহযোগিতায় নেমেছে বলে অভিযোগ উঠছে।

বলা হচ্ছে, যারা পেছন থেকে এ বিষয়ে খেলছেন তাদের কারো নামই আসছে না কাগজপত্রে। ফলে সরকার পড়ছে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হওয়ার শংকায়। আর একটি চক্র লাভবান হলেও বঞ্চিত হচ্ছে বড় অংশটি।

নিয়ম অনুসারে, বিদেশের সঙ্গে টেলিফোন কল আদান-প্রদানের জন্য বর্তমানে ২৯টি গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) অপারেটর রয়েছে। যার মধ্যে ৫২৩ কোটি টাকা বাকি ফেলে লাপাত্তা হওয়ায় ছয়টির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

আইজিডব্লিউ প্রতি মিনিটের একটি কল দেশে আনার জন্যে সর্বনিন্ম দেড় সেন্ট করে পায়। এই দেড় সেন্টই চার ভাগে ভাগ হয়। এর মধ্যে সরকারের অংশ সবচেয়ে বড় ৪০ শতাংশ।

মাত্র কয়েক মাস আগেও কল টার্মিনেশনের সর্বনিন্ম রেট ছিল ৩ সেন্ট এবং সেখানে সরকারের অংশ ছিল ৫১ দশমিক ৭৫। যেটি উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু এবার আর নিলাম নয়, বরং নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কমানো হয়েছে সরকারের প্রাপ্য অংশ।

বার্ষিক লাইসেন্স ফি ছিল সাত কোটি টাকা যেটি অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। এর সব কিছুর পেছনে ওই চক্রটি কাজ করছে কয়েক বছর ধরে।

সম্প্রতি সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠায় তাদের যে পরিকল্পনা সেখানে চালু থাকা ২৩টি আইজিডব্লিউ’র মধ্য থেকে সাতটিকে নির্বাচন করা হয়েছে। মূলত এরাই এখন ব্যবসাটি করবে।

নির্বাচিত সাতটিকে বলা হচ্ছে টায়ার-২, আর বাকিরা টায়ার-১।

নিয়মটা এমন করা হয়েছে- যেখানে সকল আইজিডব্লিউ-ই বিদেশ থেকে কল আনবে, কিন্তু গ্রাহককে কল দিতে পারবে কেবল ওই সাতটি আইজিডব্লিউ বা টায়ার-২ অপারেটররা। টায়ার-১ আইজিডব্লিউ কল যারা আনবে তাও যেতে হবে ওই টায়ার-২’র মাধ্যমেই।

আর এখানেই সিন্ডিকেশনের পুরো ফায়দা। এক্ষেত্রে আইজিডব্লিউগুলোর রেভিনিউ’র যে অংশ প্রাপ্য সেটির মোট অংশের মধ্যে টায়ার-১ এক টাকা পেলে টায়ার-২ পাবে এক টাকা ৯০ পয়সা।

গ্লোবাল ভয়েস, রুটস কমিউনিকেশন, ইউনিক ইনফোওয়ে এবং ডিজিকন এই চারটি আইজিডব্লিউ’র কাছে বিটিআরসি বা সরকারের পাওনা যথাক্রমে ৮৭ কোটি ৭৩ লাখ, ৬১ কোটি ৬২ লাখ, ৭৫ কোটি ৩১ লাখ এবং ৭৯ কোটি ১২ লাখ।

প্রতিটি অপারেটরই রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী।

এর বাইরে আরো তিনটি পুরনো আইজিডব্লিউকেও নেওয়া হয়েছে টায়ার-২ হিসেবে। ২০০৮ সালে লাইসেন্স পাওয়া ওই তিনটি অপারেটরের কাছে অবশ্য পাওনার পরিমাণ খুব বেশি নয়।

বিটিআরসি’র এক কমিশনার জানিয়েছেন, জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে নতুন নিয়ম চালুর চেষ্টা চলছে। তবে আরো কারিগরি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে একটু সময় লাগতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু মাত্র সাতটি আইজিডব্লিউ সিন্ডিকেশন, ফলে ইচ্ছে মাফিক কল রেট বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগও পাবেন তারা। কল টার্মিনেশন রেট প্রতি মিনিটের জন্যে দেড় সেন্টকে বাড়িয়ে চার, পাঁচ এমনকি আরো বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগও তারা পাবেন,  যেহেতু সব কল আসবে তাদের গেটওয়ের মাধ্যমে। তারা সংযোগ না দিলে অন্য কেউ বৈধভাবে দেশে কল আনতে পারবে না। কিন্তু সরকারের সঙ্গে বা মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগি হবে ওই দেড় সেন্ট অনুসারে।

পাকিস্তানেও বছর দুয়েক আগে এমন সিন্ডিকেশন হয়েছিল। ওই দেশে সরকার নির্ধারিত টার্মিনেশন রেট এক সেন্ট ছিল। কিন্তু সিন্ডিকেটটি আট সেন্টের নিচে কোনো দলকে দেশে ঢুকতে দিত না। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কয়েক দেশ পাকিস্তানে কল পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

পরে এক পর্যায়ে ক্লিয়ারিং হাউজ নামের এই সিন্ডিকেশনকে অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করে দেয় তাদের দেশের হাইকোর্ট।

আইজিডব্লিউগুলোর মধ্যে কয়েকটি এই নিয়মকে মেনে নেয়নি। তারা এটিকে আইনের লংঘন বলে প্রতিবাদও করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু গত্যন্তর না দেখে তারা কোর্টে যায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সিনিয়র কোনো আইনজীবীকেই রিট শুনানির জন্যে পাচ্ছিল না বিক্ষুব্ধ আইজিডব্লিউগুলো।

অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসও রিটের বিরোধিতা করে বিটিআরসি এবং সিন্ডিকেশনের পক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে মামলা খারিজ হয়েছে।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিক্ষুব্ধ আইজিডব্লিউ’র কর্মকর্তারা ভয়ে এখন সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের নাম প্রকাশ করে কথাও বলতে চান না।

নাম না প্রকাশের শর্তে একজন বলেন, এক বছরও যদি এই প্রক্রিয়া চালু রাখা যায় তাহলে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা এখান থেকে বের করে নেওয়া সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।