ঢাকা: অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও সম্ভাব্য সব উপায়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এ অর্জন অনেকটাই ম্লান করে দেয় ইঁদুর।
প্রতিবছর খাদ্যশস্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে এই ইঁদুর। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১১ প্রজাতির ক্ষতিকর ইঁদুর শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাঠের কালো ইঁদুর, গেছো ইঁদুর, খাটো লেজযুক্ত ইঁদুর ও নেংটি ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। এরা বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার খাদ্যশস্যের ক্ষতি করে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) এক জরিপে দেখা গেছে, ইঁদুর গমের তিন থেকে ১২ ভাগ, জলি আমন ধানের পাঁচ থেকে সাত ভাগ, রোপা আমন ধানের এক থেকে তিন ভাগ এবং প্রতিবছর গুদামজাত শস্যের প্রতি কৃষক পরিবারের গড়ে ৫০ কেজি ধানের ক্ষতি করে।
ইঁদুরের আক্রমণে বছরে খাদ্যশস্যের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় একশ ৫০ হাজার মেট্রিক টন থেকে চারশ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এছাড়া ইঁদুর অনেক মারাত্মক রোগের বাহক যেমন, প্লেগ র্যাট বাইট ফিভার, স্যালমোনেলোসিস।
এ ছাড়া ইঁদুর খাদ্যে বিষক্রিয়াসহ প্রায় ৪০ রকমের রোগ বিস্তার করে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবছর ৭৭ হাজার মেট্রিক টন গম, ৮৮ হাজার মেট্রিক টন ধান এবং ৫০ হাজার মেট্রিক টন গুদামজাত শস্য ইঁদুরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে ইঁদুর দানাদার শস্যের (ধান ও গম) বাৎসরিক মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. রফিকুল ইসলাম মন্ডল বাংলানিউজকে বলেন, শুধু ইঁদুরের আক্রমণেই আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে কারণে আমরা কয়েকটি উপজেলায় ইঁদুর দমনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করবো। আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকের জমি পরিদর্শন করবো। ইঁদুরের বংশ বিস্তার বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করবো এবং ইঁদুর ধ্বংসের নানা কৌশল উদ্ভাবন করবো; যাতে করে ইঁদুরের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করা যায়।
সংস্থাটি সূত্রে জানা গেছে, ইঁদুর নিধনে প্রয়োজনীয় গবেষণা করা হবে। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অফিস, ল্যাব ও মাঠ পর্যায়ের যন্ত্রপাতি কেনা হবে। ইঁদুরসহ নানা ধরনের অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণী ধ্বংসে প্রকল্পও হাতে নেওয়া হবে।
‘বাংলাদেশ অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণীর গবেষণা জোরদারকরণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ইঁদুরসহ অন্যান্য ক্ষতিকর মেরুদণ্ডী প্রাণী নিধনের পন্থা বের করা হবে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে, ২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সরকারি খাত থেকে প্রকল্পের টাকা সংস্থান করা হবে।
প্রকল্পটি ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন সাল নাগাদ বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। ৭টি জেলার ১৪টি উপজেলায় এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত হবে।
এরপর এটি পর্যায়ক্রমে সারাদেশে বাস্তবায়িত হবে। পাইলট প্রকল্প এলাকাগুলো হচ্ছে- গাজীপুর সদর, চট্টগ্রাম সদর, হাটহাজারী, খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, রামগড়, মৌলভীবাজার সদর, রাজশাহী সদর, ঈশ্বরদী, রংপুর সদর, দিনাজপুর সদর, বরিশালের বাবুগঞ্জ, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও যশোর সদর উপজেলা।
সূত্র জানায়, ইঁদুর ছাড়াও কাঁঠবিড়ালি কৃষিপণ্যের বেশি ক্ষতি করে থাকে। কাঁঠবিড়ালি নারিকেল, ডাব, পেয়ারা, আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি ফসলের ক্ষতি করে থাকে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ফসল কাঁঠবিড়ালি ও ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে।
বিভিন্ন ধরনের পাখি (কাক, টিয়া, গোশালিক) মাঠে অঙ্কুরিত গম, চীনাবাদাম, সয়াবিন, ভুট্টা এবং পাকা অবস্থায় সূযমুখীসহ বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসবজি খেয়ে ক্ষতি করে। এদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ থেকে ২০ ভাগ। তবে কৃষক একটু সচেতন হলে পাখির হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি। এই বিষয়ে কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য বিভিন্ন প্রজাতির অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণী সংগ্রহ, জরিপ, শনাক্তকরণ এবং ক্ষতির ধরন এবং পরিমাণ নিরূপণ করা; ক্ষেতের ফসল গুদামজাত সামগ্রী ও বসতবাড়ির জন্য যুযোপযোগী সমন্বিত অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণী দমন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা;
অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণিবিভাগের মানবসম্পদ উন্নয়ন করা; প্রশিক্ষণের ফলাফল প্রদর্শন ও প্রকাশনার মাধ্যমে ক্ষতিকর প্রাণীর আধুনিক দমন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিসমূহ কৃষকদের কাছে বিস্তার করা।
এ ছাড়া অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণীর জন্য আধুনিক গবেষণাগার স্থাপন করা, যাতে করে এসব প্রাণীর হাত থেকে কৃষকের ফসল রক্ষা পায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. জালাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শুধু ইঁদুরই বছরে ৫০০ কোটি টাকার ফসল খেয়ে ফেলে। এদের আমরা সরাসরি মেরে ফেলতে পারবো, এতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু কাঠবিড়ালি, কাক, টিয়া, শিয়ালসহ অন্যদের মেরে ফেলতে পারবো না।
ফসলের ক্ষতি না করে কীভাবে এদের প্রকৃতিতে সুন্দর মতো বাঁচিয়ে রাখা যায়, সে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৫
এমআইএস/এবি