মংলা থেকে: কয়েক বছর আগেও যে বন্দর ছিলো ইমেজ সংকট আর লোকসানে জর্জরিত। বর্তমান সরকারের নানামুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে প্রাণ ফিরে পেয়েছে পশুর নদী তীরের মংলা সমুদ্র বন্দর।
লোকসান ঘুচানোর পাশাপাশি বেড়েছে আমদানি-রফতানিও। এ কারণে বন্দর ব্যবহারে বিদেশি উদ্যোক্তাদেরও আগ্রহ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দর উন্নয়নে নেওয়া সবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং খান জাহান আলী বিমানবন্দর চালু হলে মংলা বন্দরের গতি বাড়বে। আর মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মাসেতু চালুর পর পুরোপুরি প্রাণচাঞ্চল্য ফিরবে মংলায়। পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও বাড়বে।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ১৯৫০ সালের ১ ডিসেম্বর চালনা অ্যাংকোরেজ নামে এ বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে বন্দরটি বর্তমান স্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭৬ সালে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর ও চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ নামকরণ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৭ সালে নতুন নামকরণ করা হয় মংলা পোর্ট অথরিটি (মবক)।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মংলা বন্দরে ১৯৮০ সাল থেকে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং শুরু হয়। তবে ২০০১ সালের পর থেকে এই বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যা চলতে থাকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
এতে লোকসানের মুখে পড়েন সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও স্থানীয়ভাবে বিনোয়োগকারীরা।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, এক সময় দেশের মোট আমদানি-রফতানি পণ্যের ৩০ শতাংশের বেশি এ বন্দরে হতো। কিন্তু এক পর্যায়ে তা ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
‘এক সময় এমন অবস্থা হলো বছরে মাত্র ৯৫টি জাহাজ আসে,’ বলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল একমাত্র সমুদ্র বন্দর। সে সময় বিশ্বে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
আর দেশের অধিকাংশ পাট দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উৎপন্ন হওয়ায় এ অঞ্চলকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল অনেক পাট শিল্প। সহজে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করতেই মূলত মংলা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এর পরিধি আরও বাড়ে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, নব্বই দশকের শুরুতে বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের মন্দা, দেশের পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া, রফতানি বাণিজ্যে পরিবর্তন হওয়া, শ্রমিক অসন্তোষসহ বিভিন্ন কারণে মংলায় বিদেশি জাহাজের আগমন কমতে থাকে।
‘এছাড়া কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অব্যাহত শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ফলে বন্দরে রাজস্ব আদায়ও শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায়। ’
মংলা বন্দর ব্যবহারকারী সমন্বয় কমিটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মংলা বন্দরের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বলতে গেলে অচল বন্দর সচল হয়েছে।
‘বর্তমানে আমদানি-রফতানিকারকরা এখন মংলা বন্দর ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। বিনিয়োগও বাড়ছে,’ বলেন তিনি।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৯ সালের শুরুতেই সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের
কারণে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে মৃতপ্রায় মংলা বন্দরে।
‘২০০৯ সালের জুন থেকে এ বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি করা হচ্ছে,’ বললেন তিনি।
মবক চেয়ারম্যান জানান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নির্দেশনা, বন্দর উপদেষ্টা কমিটি ও বন্দর ব্যবহারকারীদের সুপারিশ এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বন্দর ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।
২০০৯ সালের পর থেকে প্রায় ৫৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে মংলা বন্দরে মোট ৮টি উন্নয়ন প্রকল্প ও ৪টি উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরইমধ্যে ৫টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।
এসব কর্মসূচির আওতায় চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং, আধুনিক হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ, ড্রেজার, সহায়ক জলযান, দিবারাত্রি জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে নেভিগেশনাল এইডস সংগ্রহ ও স্থাপন, কার পার্কিং ইয়ার্ড, সোলার প্যানেল স্থাপন উল্লেখযোগ্য।
রিয়ার এডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে মংলা বন্দর পুনরায় লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৮ কোটি টাকার অধিক নিট মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও জাহাজ ও কার্গো হ্যান্ডলিং বাড়ানোর ধারা অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।
বাগেরহাট-৩ আসনের (রামপাল-মংলা) সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলকে অর্থনৈতিকভাবে সচল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মংলা বন্দরের উন্নয়নে নানা প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন।
‘মংলা বন্দরকে ঘিরে ইপিজেড, অর্থনৈতিক জোন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপন, বিমানবন্দর নির্মাণ, রেললাইন নির্মাণসহ জাহাজ বন্দরে আসার জন্য নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে মাদার ড্রেজার ক্রয় করা হয়েছে। যা দিয়ে নদী খনন কাজ শুরু হয়েছে। ঘষিয়াখালী চ্যানেল খনন কাজ চলছে,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৫
এমআরএম/এমএ/এটি