ঢাকা: চট্টগ্রামের কোরিয়া রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা কেইপিজেড ইস্যুর দ্রুত সমাধান উভয় পক্ষের জন্যই ভালো হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি ইউন ইয়াং।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ।
তিনি বলেন, সেখানে (কেইপিজেড) যদি এখন স্যামসাংয়ের বিনিয়োগ থাকত, তাহলে অন্য বিনিয়োগকারীরাও উৎসাহিত হতো। যেমন স্যামসাং গত বছর শুধু ভিয়েতনাম থেকেই ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মোবাইল ফোন রফতানি করেছে। এটি অন্য বিনিয়োগকারীদেরও ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করতে সাহস জোগাচ্ছে। যে কারণে সেখানে শুধু কোরিয়ান তিন হাজার ৫০০ কোম্পানি বিনিয়োগ করতে চলে গেছে। স্যামসাংয়ের বিনিয়োগের সাকসেস স্টোরিই এত বিপুলসংখ্যক কোরিয়ান কোম্পানিকে সেখানে যেতে উৎসাহিত করেছে। অথচ এই বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসতে পারত। কিন্তু আসেনি। ’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এখন কেইপিজেডকে যদি সাককেস স্টোরি হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা যায়, তাহলেও কিন্তু বিনিয়োগের অসীম সম্ভাবনা তৈরি হবে। ’
কেইপিজেডের সঙ্গে ঘটা ঘটনাগুলো নিয়ে খানিকটা হতাশ রাষ্ট্রদূত লি ইউন ইয়াং বলেন, ‘কেইপিজেড প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। দুই রাষ্ট্রের সমঝোতার ভিত্তিতেই কোরিয়া সরকার ইয়াংওয়ান কোম্পানিকে ইপিজেড স্থাপনের দায়িত্ব দেয়। বাংলাদেশ সরকার জমি দেয়। তখন সেখানে পতিত জমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কেউ সেখানে যেত না। কিন্তু এখন সেখানে গেলে অবাক হতে হয়। সারি সারি রাস্তা, ২০ লাখ গাছ, বিনিয়োগ-উপযোগী প্লট- সবই হয়েছে। কিছু কাজ চলছে। ইতিমধ্যে বিশ্বে পরিবেশসম্মত এক নম্বর ইপিজেড হিসেবে জাতিসংঘ সংস্থা রামসা কেইপিজেডকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। অর্থাৎ কেইপিজেড এখন বিশ্বের অনেকের কাছে অনুকরণীয়।
তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে কেইপিজেডের জন্য বরাদ্দ দেওয়া জায়গা ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে আমি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমাকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। ’
লি ইউন ইয়াং বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ যাত্রায় প্রয়োজন বিনিয়োগ। অবশ্য এ দেশের অনেকেই ভাবছেন, বাংলাদেশ ছাড়া বিদেশিদের বিনিয়োগের জায়গা নেই। আমার মতে, এমন ভাবনা অতিমাত্রায় আত্মতুষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। ’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘কোরিয়া বাংলাদেশের প্রাচীনতম বন্ধু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পর কেউ এখানে আসেনি। শুধু কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরাই বিনিয়োগে এসেছে। টেক্সটাইল শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে কোরিয়ার সম্পর্কের শুরু। সে সময় বাংলাদেশ থেকে ৩৩২ জনকে প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারাই কিন্তু এখন বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশে কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করার পর লি ইউন ইয়াংয়ের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ফিরে যাবেন সেপ্টেম্বরের শেষে।
বাংলাদেশের সঙ্গে কোরিয়ার সাদৃশ্য তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘বাংলাদেশের মতো কোরিয়ারও তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল না। ছিল শুধুই জনশক্তি। সেই জনশক্তিকেই সম্পদে পরিণত করে গত চার-পাঁচ দশকে অনুন্নত রাষ্ট্র থেকে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। তবে কোরিয়ার ছিল অত্যন্ত দক্ষ নেতৃত্ব, প্রবল আত্মবিশ্বাস ও একদল সৃজনশীল উদ্যোক্তা। এ কারণেই আজ স্যামসাংয়ের মতো ব্র্যান্ড আছে কোরিয়ার, জাহাজ নির্মাণশিল্পেও বিশ্বের এক নম্বরে অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয়েছে, সাফল্য এসেছে অটোমোবাইলে। আসলে কোরিয়ার জনগণের ডিএনএতেই ব্যবসায়িক সৃজনশীলতা মিশে আছে। ’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বিনিয়োগের লক্ষ্যস্থল হিসেবে নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশকিছু প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা সেখানে পাবেন। ভিয়েতনামের পর এখন বিনিয়োগের জন্য ইথিওপিয়াকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সেখানে নানা সুবিধার পাশাপাশি ইউরোপের বাজার ধরার সুযোগ আছে। এ কারণে বাংলাদেশকেও তার প্রতিদিন বাড়তে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বীদের কথা বিবেচনায় নিতে হবে। ’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে যাই, যখন এখানকার অনেকেই বাংলাদেশ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের জায়গা নেই বলে মন্তব্য করেন। কারণ বাংলাদেশে শ্রম মূল্য কম। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য শুধু সস্তা শ্রমই প্রয়োজন এটা ঠিক নয়। এখানে অবকাঠামোর স্বল্পতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অভাব, যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহায়তাসহ নানা কিছুর সমস্যা আছে। বিনিয়োগকারীরা সবকিছুই বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নেয়।
কেইপিজেপের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, শুধু লাইসেন্স পেতেই লেগে গেল ১২ বছর। বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে আবার বিচ্ছিন্ন করা হয়। গ্যাস তো দেওয়াই হয়নি। মনে রাখতে হবে, এগুলো বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে নেন না। ’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করছেন। সেখানে তারা কোনো ধরনের বিরূপ আচরণের শিকার হন না। সবার মতো তাদের সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে ছয়-সাত গুণ বেশি বেতন পান তারা। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় তারা বেশি ওভারটাইম পান। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাচীনতম বন্ধু কোরিয়ার সঙ্গে এখানে কেন এমন আচরণ! আসলে সব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রয়োজন। আইনের শাসন ছাড়া সবই ব্যর্থ হয়ে যায়। বাংলাদেশের এখানেই সমস্যা। ’
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করব কেইপিজেড নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা অচিরেই কেটে যাবে। কারণ বাংলাদেশে গার্মেন্ট খাতে কোরিয়ার প্রমাণিত সাফল্য আছে। সেসব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্তই নেবে। এটা দুপক্ষের জন্যই ভালো। ’
গত মঙ্গলবার বারিধারায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেইপিজেড নিয়ে এসব মন্তব্য করেন কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টাম জুলাই ০৬, ২০১৫
কেএইচ