ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বাজার অব্যবস্থাপনায় কমছে তাঁত ও কারিগরের সংখ্যা

আবু খালিদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
বাজার অব্যবস্থাপনায় কমছে তাঁত ও কারিগরের সংখ্যা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) থেকে ফিরে: সুতার তারতম্য ঠিক রাখার জন্য সমান তালে দুই পা দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যান একজন কারিগর। একই গতিতে তার দুই হাতও চলে সুতার রঙ ঠিক রেখে শাড়ি বুনন ও সুতা প্রতিস্থাপনের কাজে।


 
নিবিড় মনোযোগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে বুননের পরই তৈরি হয় একেকটি কাপড়। সেটি হতে পারে শাড়ি, লুঙ্গি বা গামছা। তাঁতীর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ আর তাঁত যন্ত্রের মিলিত প্রয়াসে তৈরি হওয়া কাপড় বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা আনবেন, সে আশাতেই বুক বাঁধেন তারা।
কিন্তু বর্তমানে অনেকটা বিপরীতমুখী অবস্থাই মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাঁতীদের। মিলছে না সঠিক পারিশ্রমিক ও কাপড়ের দাম। নির্ভরতা বাড়ছে মহাজনদের দাদনের টাকার উপর। একসময় ঋণে জর্জরিত হয়ে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে তাঁতখানা।
 
সবমিলিয়ে ভালো নেই দেশের ঐতিহ্য বহনকারী তাঁত শিল্পীরা। যতই দিন যাচ্ছে ততই কমছে কারিগরের সংখ্যা। অভিযোগ রয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ের তাঁতীদের কাছে সরকারের কোনো ধরনের সহায়তাই পৌঁছায় না।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি আর তাঁতীদের সঠিকভাবে দেখভাল করলে দেশের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে পুরোনো রূপে দেখা যাবে। তাঁতের শব্দে যে সুর তৈরি হয়, সেই সুরের তালেই বেঁচে থাকতে চান কারিগররা। এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাবেন, এমন ভাবনা তারা আনতে চান না।
তাঁত শিল্পখ্যাত এলাকা সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, কাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কারিগর ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেলো এমন চিত্র। এরমধ্যে শাহজাদপুর এলাকার তাঁতীরা শুধু শাড়ি ও কাজীপুর এলাকার তাঁতীরা বানান লুঙ্গি-গামছাসহ বিভিন্ন কাপড়।
 
শাহজাদপুর উপজেলার দূর্গানগর ইউনিয়নের তাঁতী হাবিবুর রহমানের ৮টি তাঁত ছিল। বর্তমানে চালু রয়েছে ৪টি।
 
হাবিবুর জানান, একটি শাড়ি তৈরি করতে একজন তাঁতীকে কয়েক ঘণ্টা কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। তাঁতীদের পরিশ্রমের কোনো ঘাটতি থাকে না। কেবল বাজার অব্যবস্থাপনা আর সরকারের সদিচ্ছার অভাবে পথে বসে যেতে হচ্ছে তাদের। অথচ তাঁত কাপড়ের কদর এখনও আগের মতোই রয়েছে।
দাবাড়িয়া এলাকার তাঁতী হোসেন আলী জানান, ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে তাঁত বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। যদি কাপড়ের সঠিক দাম পাওয়া যেত তাহলে তাঁতগুলো বন্ধ হতো না বরং আরও বেশি হতো। দিন দিন তাঁতীরা খুবই অসহায় হয়ে পড়ছেন।
 
প্রায় ২৪ বছর ধরে তাঁতের সঙ্গে জীবন কাটানো কারিগর রফিকুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, খঞ্জনদিয়ার গ্রামে পা দিলেই তাঁতের কাপড় বুননের শব্দে অন্যরকম এক আবহ তৈরি হতো। কিন্তু দিন দিন তাঁতের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে এলাকাটি। বেকার হয়ে পড়েছেন তাঁত কারিগররা। আমার  নিজের ১৬টি তাঁত ছিল, বর্তমানে রয়েছে ৮টি।
 
তাঁত শিল্পী আব্দুল জলিল জানালেন, একটি তাঁতের শাড়ি তৈরিতে তাঁতী পরিবারের সবার অংশগ্রহণ ও পরিশ্রম থাকে। শিশু থেকে শুরু করে বাড়ির সবাই মিলেই তাঁত কারখানাগুলো পরিচালনা করে থাকে। এতে তাঁতের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু আজ সেই সম্পর্কে ছেদ পড়তে শুরু করেছে।
রূপপুর এলাকার সলেমান সব তাঁত বিক্রি করে দিয়ে কাপড় বিক্রির ব্যবসা করছেন।

তিনি বলেন, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছিলাম না। আর প্রতিবছরই ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিল। বাধ্য হয়েই পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় আসতে হলো।
 
শাহজাদপুর এলাকার একাধিক এলাকা ঘুরে কমপক্ষে ৩৫ জন তাঁত কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হতাশা আর অসহায়ত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না তৃণমূল পর্যায়ের কারিগররা।
 
তাঁতীদের অভিযোগ, তৃণমূল ও গ্রামের তাঁতীরা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। সরকারি ঋণ নিতে গেলে অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়।
শাহজাদপুর তাঁত কাপড় ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও কারিগর আলমাস আনসারী বাংলানিউজকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে হবে। এখন গ্রাম পর্যায়ে নারীদের থ্রিপিস পরার প্রবণতা বেড়েছে। তাই তাঁত কাপড়ের বাজার তৈরিতে সরকারকে নজর দিতে হবে।
 
তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর আগেও এ অঞ্চলে (সিরাজগঞ্জ ও পাবনা) প্রায় পাঁচ লাখ তাঁতী কাজ করতেন। আজ সেই সংখ্যা আড়াই থেকে তিন লাখ।
 
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তাঁতে বোনা কাপড়ের কদর ইউরোপসহ সারা বিশ্বে রয়েছে। তাঁতীরা নিজের উদ্ভাবনী শক্তি আর দক্ষতা দিয়ে প্রতিটি কাপড় তৈরি করেন। তাদের বানানো কাপড়ের সঙ্গে মেশিনে তৈরি কাপড়ের পার্থক্য অনেক। তাই আর্থিক দিক দিয়ে বিবেচনা করে হলেও এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা উচিত।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৫
একে/এসএস

** তাঁত কাপড়ের দাম কম, লোকসানে তাঁতীরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।