বগুড়া: প্রথমে কাঁচামাল আগুনে গলিয়ে নেওয়া হয়। পরে ফুটন্ত অবস্থায় সেই কাঁচামাল নির্দিষ্ট ফ্রেমে ঢালা হয়।
লেদ মেশিনে নেওয়ার আগে অধাপ্রস্তুত পণ্যটিকে আরেকটি মেশিনে ঘষে নিয়ে মেশিনে নির্ধারিত মাপে কাটতে হয়। অতঃপর ফিনিশিংয়ের কাজ সেরে তা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে ধরন অনুযায়ী অসংখ্য পণ্যের গায়ে স্প্রে আকারে রংয়ের প্রলেপও মারা হয়।
এভাবেই প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কয়েকশ ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফাউন্ড্রি শিল্প কারখানায় চলে নানা কর্মযজ্ঞ। এসব কারখানায় বিভিন্ন ধরনের সেচ পাম্প, লায়নার, পিস্টন ও টিউবওয়েলসহ যাবতীয় কৃষি যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করা হয়।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া প্রায় সবখানেই পাওয়া যাবে বগুড়ায় উৎপাদিত এসব যন্ত্রাংশ। বাজারও দখল করেছে বেশ। কোথাও কোথাও একচেটিয়া ব্যবসাও করছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এমন পরিস্থিতির কথাই জানা যায়।
বগুড়ায় ধোলাইখাল মডেল প্রকল্পের আওতায় ফাউন্ড্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় উৎপাদিত সেচ পাম্প, লায়নার, পাম্পের যন্ত্রাংশ, ডিজেল ইঞ্জিন, পাওয়ার ট্রিলার, টিউবওয়েল, কাস্ট আয়রণ ও স্টিল আয়রণের যন্ত্রাংশ, সুগার মিলের যন্ত্রাংশ এবং পিস্টনসহ কৃষি যন্ত্রাংশ দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেন এসব দ্রব্যের উৎপাদক ও বিক্রেতারা।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় ভারত, পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড থেকে লেদ মেশিন আমদানি ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ স্থাপনের কথা ভাবাই যেতো না। কিন্তু এখন আগের সেইদিন নেই। সময়ের ব্যবধানে বগুড়ায় এখন পূর্ণাঙ্গ লেদ মেশিন তৈরি করা হয়েছে। যা দিয়ে এ অঞ্চলে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
এছাড়া, এখানে সরিষার তেলের যান্ত্রিক ঘানি, সেমাই মেশিন, ইক্ষু মাড়াই যন্ত্র, ইট ভাটায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্র, খোয়া-সিমেন্ট-বালু মিশ্রণের মেশিন, শ্যালো নৌকা, শ্যালো ভ্যান তৈরির যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি প্রস্তুত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এক সময় দেশে মিলনার্স কোম্পানির কেএসবি ও ফার্মল্যান্ড সেচ পাম্পের একচেটিয়া বাজার ছিল। প্রায় ৩০ বছর আগে এসব পাম্প ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। বোরো মৌসুমে ফসলি জমিতে প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৎকালীন ঢাকার ওই দু’টি শিল্প প্রতিষ্ঠান সেচ পাম্প বিক্রি করে কৃষকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতো।
বগুড়ার স্থানীয় সুমন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’র স্বত্বাধিকারী জিল্লার রহমান বাংলানিউজকে জানান, নানা সমস্যা ও ভাবনা থেকেই স্থানীয় কারিগররা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেচ যন্ত্র তৈরির উদ্যোগ নেন। কোনো একাডেমিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রমিকরা দক্ষতার সঙ্গে শহরের বিভিন্ন স্থানে এসব কারখানায় কাজ করে যাচ্ছেন।
বর্তমানে বগুড়ায় উৎপাদিত মিলটন, এসআর, বাশার, মদিনা, আজাদ পাম্পসহ বিভিন্ন কারখানায় প্রতিদিন হাজার হাজার পাম্প বানানো হচ্ছে। যা অপেক্ষাকৃত স্বল্প দামে কৃষকরা কিনতে পারছেন।
নিউ আলিফ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’র স্বত্বাধিকারী শাহজামাল বাংলানিউজকে জানান, মূলত ১৯৯৮ সালের জুন মাসে যমুনা (বঙ্গবন্ধু) সেতু চালুর পরপরই এসব পণ্য দ্রুত সারা দেশের বাজার দখল করে।
অল্প সময়ের মধ্যে এসব উন্নত মানের পাম্প দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতেও পাচার হতে থাকে।
ফাউন্ড্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে বগুড়ার ভূমিকার বিষয়টি তৎকালীন সরকারের নজরে আসে। ফলে এই শিল্পের বিকাশে সরকার ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে ধোলাইখাল মডেল প্রকল্প গ্রহণ করে।
স্থানীয় এসব কারখানার মালিক ও উৎপাদকেরা জানান, সে সময় বগুড়ায় ধোলাইখাল মডেলে আরও ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তাদের মধ্যে লাখ লাখ টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। এরপরও নানা সমস্যা ও মূলধনের অভাব থেকেই যায়।
এ অঞ্চলে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠেছে মাঝারি ও হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প কারখানা। এখানে বেশ কিছু সংখ্যক বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এর মধ্যে হক মেটাল ভারী যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে।
এছাড়া, অন্যগুলোতে বিভিন্ন মাপের কড়াই, বাটখারা, জালকাঠি, সেচ পাম্প, তাওয়া, টিউবওয়েল, লায়নার, পিস্টনসহ নানা পদের যন্ত্রাংশ তৈরি করে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ শিল্পের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত ভালো। তাই এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উদ্যোক্তাদের জন্য নাম মাত্র সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই এ শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৫
এমবিএইচ/টিআই