ঢাকা: ভোগান্তি আর প্রতারণার অভিযোগে জর্জরিত বিকাশ। ব্র্যাক ব্যাংকের এই সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনে (ক্যাশ-আউট) অতিরিক্ত টাকা গুণতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
ব্যাংকের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে টাকা পাঠানোর সুযোগ থাকলেও বিকাশে প্রতি হাজারে ২০ টাকা গুণতে হচ্ছে গ্রাহককে। এই হার বর্তমানের নির্ধারিত হারের চেয়েও দেড় টাকা বেশি। উপরন্তু এটা দিন দিনই বাড়ছেই।
নিয়ম অনুযায়ী কমিশন হিসেবে প্রতি হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা কেটে নেবেন এজেন্ট।
শুরুর দিকে টাকা পাঠাতে হাজারে ১২ টাকা কমিশন পেতেন বিকাশ এজেন্ট। পরে এই হার বেড়ে হয় হাজারে ১৫ টাকা। আর এখনকার কমিশন হার হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা।
একজন গ্রাহক তার নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে মাসে (মাসে ১০ বারের বেশি ক্যাশ-আউটের সুযোগ নেই) সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্যাশ-আউট করতে পারলেও এ জন্য তাকে খরচ গুণতে হয় তিন হাজার টাকা। দৈনিক সর্বোচ্চ ক্যাশ-আউটের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা (দিনে ৩ বার ক্যাশ-আউটের বেশি নয়)। এতে চার্জ ৫০০ টাকা। যা নিতান্তই ব্যয়বহুল। সব মিলিয়ে বিকাশ ব্যবহারকারীদের এখন রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠছে।
অভিযোগ আছে, বিকাশের সেন্ড মানির টাকা ক্যাশ-আউট করলে চার্জ কেটে রাখা হয় প্রেরকের কাছ থেকে। প্রাপক যদি সে টাকা ক্যাশ-আউট করতে চান সেক্ষেত্রে তাকেও বাড়তি অর্থ নিয়ে টাকা তুলতে হয়। অর্থাৎ উভয় দিক থেকেই বাড়তি টাকা তোলার খেলায় মেতেছে বিকাশ নামক প্রতিষ্ঠানটি। যিনি টাকা পাঠান; আর যিনি গ্রহণ করেন দুদিকেই চার্জ কাটা হচ্ছে।
এ বিষয়ে এক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। তার নাম শাহনেওয়াজ। সম্প্রতি নাটোর থেকে ঢাকায় তার চাচার কাছে টাকা পাঠান তিনি। পাঠানো দরকার ১০ হাজার টাকা। তার চাচা এবং তিনি দু’জনই বিকাশ ব্যবহার করেন। শাহনেওয়াজ ওই টাকা বিকাশে পাঠাতে গিয়ে হলেন হেনস্তা। বিকাশের সেন্ড মানি সুবিধায় তাকে চার্জ দিতে হবে ৫ টাকা। শুধু তাই নয়, ওই টাকা হাতে পেতে তার চাচাকেও ক্যাশ-আউটে পরিশোধ করতে হবে আরও ২০০ টাকা। সর্বমোট খরচ ২০৫ টাকা। ‘এ কী অবস্থা’- বলেন শাহনেওয়াজ।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে পাশে বিকাশ, কী স্লোগান তাদের! আসলেই তো প্রয়োজনে গলা কেটে নেওয়া বিকাশ...’।
শাহনেওয়াজ বলেন, পরে ফোন দিলাম চাচাকে। নিলাম তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর। অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলাম কাঙ্ক্ষিত ১০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে আমাকে দিতে হলো মাত্র ২৩ টাকা।
তিনি বলেন, আমরা নিম্নবিত্ত মানুষ। আমাদের পক্ষে বিকাশে এতো চার্জ দিয়ে টাকা পাঠানো সম্ভব নয়। আর এখন তো অনলাইন ব্যাংকিংয়ের যুগ। ব্যয়বহুল বিকাশে অতিরিক্ত চার্জ দিয়ে টাকা পাঠাবো?
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জি এম আবুল কালাম আজাদ (মহাব্যবস্থাপক প্রটোকল দায়িত্ব) বাংলানিউজকে বলেন, আমার মেয়ে রংপুর মেডিক্যালে পড়ে। তাকে মাসে মাসে ডাচ-বাংলায় ৫-১০ হাজার টাকা যাই পাঠাই, মাত্র ১০ টাকা লাগে। তাহলে কেন একজন সাধারণ মানুষ বেশি ব্যয়ের সেবা ব্যবহার করবে।
২০১১ সালের ২১ জুলাই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু বিকাশের। প্রতি হাজারের জন্য একজন বিকাশ এজেন্ট কমিশন পান ৪ টাকা ২০ পয়সা।
রাজধানীর লালমাটিয়ার এক বিকাশ এজেন্ট বাংলানিউজকে বলেন, চার্জ বেশিই কাটে বিকাশ। আমরাও বাধ্য, কোম্পানি রেট। এতে করে সাধারণ মানুষের সমস্যা হলেও বিকাশ চলে নিজের খেয়াল খুশি মতো। আমিও তাই, ইচ্ছা হলে মোবাইলে ক্যাশ-আউটের টাকা রাখি। আবার ইচ্ছা হলে রাখি না। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একজন এজেন্ট বলেন, আমি ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করি। বিকাশে আমার অ্যাকাউন্ট ছিল আগে, তবে এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছি নিজে থেকে। কারণ বিকাশ দিয়ে সেন্ড মানিতেও টাকা নিচ্ছি, আবার ক্যাশ-আউটের সময়ও বাড়তি দেড় টাকা কেটে রাখছি, এটা ঠিক না।
জমানো টাকার ওপর ইন্টারেস্ট দিয়ে থাকে বিকাশ। এমন প্রচারণাও তাদের কম নয়, একে প্রচারণা নয়-‘প্রতারণা’ বলছেন গ্রাহকরা। হাজারটা শর্তের বেড়াজালে এখানেও গ্রাহক প্রতারণায় বিকাশ এগিয়ে। যেমন- মাসে কমপক্ষে ২টি আর্থিক লেনদেন (ক্যাশইন, ক্যাশআউট, এটিএম ক্যাশআউট, পেমেন্ট, সেন্ডমানি অথবা বাইএয়ারটাইম) করতে হবে। মাসজুড়ে প্রতিদিন শেষে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ১ হাজার বা তার বেশি টাকা ব্যালেন্স থাকতে হবে। তারপর আবার ইন্টারেস্ট গণনা মাসশেষে প্রতিদিনের গড় ব্যাল্যান্সের ওপর। সঙ্গে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ভ্যাট এবং ট্যাক্স কেটে বছরে দুই দফায় দেওয়া হয় এই তথাকথিত ইন্টারেস্ট- অভিযোগ বিকাশ ব্যবহারকারীদের।
এছাড়া বিকাশের হটলাইন ‘১৬২৪৭’ ব্যবহার করেও সাধারণ মানুষের মোবাইলের ব্যালেন্সে ভাগ বসাচ্ছে তারা। বিকাশ গ্রাহকদের তার জরুরি প্রয়োজনের জন্য এই সেবা (হটলাইন-১৬২৪৭) ফ্রি দেওয়া উচিত বলেও মত দেন অনেকে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে চার্জ তুলনামূলক কম বিকাশ ছাড়া অন্য যে কোনো সার্ভিসে। আইএফআইসি ব্যাংক হাজারে ১৬ টাকা কমিশন কাটে। ইসলামী ব্যাংক এবং ইউসিবিএলও নিচ্ছে বিকাশের চেয়ে অনেক কম কমিশন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, বিকাশের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অ্যাকাউন্ট চালু করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত চার্জ কাটার অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে। অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিষয়টিও উঠে এসেছে বারবার। এর নমুনা হিসেবে বলা হচ্ছে, কমিশন শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে টেলিফোন অপারেটরদের সঙ্গে যে চুক্তি করা হয় সেক্ষেত্রে বিকাশ সর্বনিম্ন সুবিধা দিয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রেখেছে। ফলে প্রতিযোগিতায় আসতে পারছে না অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রায় ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা বিকাশ তাই অনিময়ম ও প্রতারণার ঘটনাও ঘটাচ্ছে বেশি।
সূত্র আরও জানাচ্ছে, বিকাশ হিসাবধারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন এর এজেন্টরা। বিকাশের নিজস্ব নজরদারির গাফিলতিতে এমনটা হচ্ছে বলে অভিযোগ। বিশেষ করে মফস্বলে ও গ্রামাঞ্চলে মানুষজন বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করেন, সেখানে নিয়ম-কানুন ও রেট সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এজেন্টরা অবাধে চালাচ্ছেন প্রতারণা। শহরেও কিছু বিকাশ এজেন্ট কৌশলে এমন প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুলাই শেষে মোবাইল ব্যাংকিং এর মোট এজেন্টের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৭৩১ জনে। এর আগের মাস শেষে যা ছিল ৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৭০। অর্থাৎ এজেন্টের সংখ্যা কমেছে ৬ হাজার ৪৩৯ জন।
বাতিল হওয়াদের অধিকাংশই বিকাশের। তবে এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ বিকাশের নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়েই এসব এজেন্টকে বাতিল করেছে। এর আগে গত মার্চ মাসে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করায় প্রায় ৬ লাখ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়। সেগুলোরও অধিকাংশ ছিলো বিকাশ নাম্বার।
দেশে বর্তমানে আরও যে সব ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা দিচ্ছে এর মধ্যে জনতা ব্যাংক, সোনালী, ডাচ-বাংলা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, আইএফআইসি, ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মার্কেন্টাইল, ব্যাংক এশিয়া, ফার্স্ট সিকিউরিটি, আল আরাফা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, কর্মাস ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ব্যাংক, ইউসিবি ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিকাশ জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে বলে তারা বেশি টাকা কাটবে তা হতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ বিষয়ক অভিযোগ রয়েছে। আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেবো, এ নিয়ে বেশ কয়েকটি মিটিং করা হয়েছে। কোনো ছাড় হবে না। সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। গ্রাহকের কাছ থেকে বেশি টাকা যাতে না কাটতে পারে এমন কঠোর নীতিমালা করা হবে।
তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৮টি ব্যাংককে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা পরিচালনার লাইসেন্স দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৫
আইএ/জেডএম