ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

একনেকে প্রকল্প পাস

১০০ ফুট চওড়া অবাস্তব খালে ৫৫৩০ কোটি টাকা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫
১০০ ফুট চওড়া অবাস্তব খালে ৫৫৩০ কোটি টাকা ফাইল ফটো

ঢাকা: ঢাকার চারপাশের দখল হয়ে যাওয়া নদীতীর দখলমুক্ত করতে সাড়ম্বরে ঢাকঢোল পেটানো হলেও অগ্রগতি কার্যত শূন্য। এসব খাল দখল ও দুষণমুক্ত করতে একাধিক মন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সও কোনো জোরালো ভূমিকা নিতে সক্ষম হয়নি নানা জটিলতায়।

উপরন্তু সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় দখল হয়ে গেছে রাজধানীর বুকে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অধিকাংশ খাল।

এরই মধ্যে নতুন করে খাল খনন করে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা জলে ফেলার  পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর কুড়িল থেকে বোয়ালিয়া পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে খনন করা হচ্ছে ১০০ ফুট চওড়া খাল। কুড়িল উড়াল সড়ক থেকে শুরু হয়ে এই খাল গিয়ে পড়বে বালু নদীতে। যা দু’পাশেই প্রায় ১৫ কিলোমিটার করে লম্বা।

এই খাল খননে মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে পাস হয়েছে ৫ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার প্রকল্প। এই টাকার পুরোটাই যোগান দেওয়া হবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে।

২০১৮ সালের মধ্যেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

অথচ এ খালের ব্যাপারে রাজউক থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিজিইআইএস) কাছে মতামত চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে গবেষণা শেষে তারা পানি নিষ্কাশনের জন্য খালের প্রয়োজন নেই মর্মে বিস্তারিত মতামত তুলে ধরে।

সূত্র জানায়, তাড়াহুড়া করে একনেকে যে প্রস্তাব তোলা হচ্ছে তা পাঁচ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার। কিন্তু খাল খনন করতে হলে এর চেয়ে চার গুণ অর্থাৎ ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন।

বুয়েটের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০০ ফুট রাস্তার পাশে ড্যাপের খালের ব্যাপারে একটি অভিজ্ঞ সার্ভে টিম কাজে লাগানো হয়েছে। সার্ভে টিমের মতামত অনুযায়ী, কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত কোনো খাল, সরকারি হালট বা খাসজমি নেই। এসব জমি সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তিমালিকানাধীন বলে সিএস ও এসএস জরিপ থেকে জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত রাজউক ও অন্য প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন অনুযায়ী ড্রেনেজের মাধ্যমে পানি বালু নদে গিয়ে পড়ে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ফ্লাইওভার থেকে শুরু করে বোয়ালিয়া খাল পর্যন্ত ৯ থেকে ১৫ মিটার প্রশস্ত খাল কেটেও যথাযথভাবে পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সে ক্ষেত্রে ৩০০ ফুট রাস্তার পাশে কোনো জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। এমনকি রাজউক ইতিমধ্যে ৩০০ ফুটের উত্তর পাশে প্রিকাস্ট কংক্রিট ব্লক দিয়ে কালভার্ট তৈরি করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেছে।

সচেতন মহল মনে করেন, খালের নামে এ বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে দেশের স্বনামধন্য প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। জনগণের কথা বিবেচনা করে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদরা খাল প্রকল্প বন্ধ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়েছেন।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, ড্যাপের রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির চতুর্থ সভায় ৩০০ ফুট কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের দক্ষিণ পাশে ১০০ ফুট প্রশস্ত ওয়াটার রিটেনশন এরিয়া পরিবর্তন করা যায় মর্মেও মতামত দেওয়া হয়েছে। রাজউক ইতিমধ্যে ৩০০ ফুট জায়গায় ১২ লেনের এক্সপ্রেস রোড, চার লেনের সার্ভিস রোডসহ সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল খননের নামে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রয়োজন নেই। ৫০ কোটি টাকা খরচ করেই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। আর লেক খনন করে সৌন্দর্য বাড়াতে হলে ১০০ ফুট জায়গায় তা প্রকৌশলগত দিক দিয়ে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। লেক খনন করতে হলে কমপক্ষে দু’পাশে ৩০০ ফুট করে ৬০০ ফুট জায়গা প্রয়োজন হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা খালের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে বুয়েটকে দিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েছি, যেখানে আমাদের প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তারা দীর্ঘ গবেষণা শেষে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানে খালের পরিবর্তে বক্স কালভার্ট করার কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে।

কিন্তু এখন এসব বিশেষজ্ঞের গবেষণা ও মতামত উপেক্ষা করে বিশাল আকৃতির খাল নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটি খালের জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচের কতোটা যুক্তি আছে তা ভেবে দেখার বিষয়।

তিনি আরো বলেন, যেখানে পানি নিষ্কাশনের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করলেই কাজ হয়, সেখানে কেন আমরা সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে যাবো?

সূত্রমতে, বহুল বিতর্কিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে দু’টি ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল খননের কথা বলা হয়। কোনো ধরনের সার্ভে ছাড়া এমন একটি প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বির্তকের জন্ম দেয়। পরে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে ড্যাপের এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাজউক। এরপর বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিশেষজ্ঞ মতামতও আনা হয়।

কিন্তু এখন আর সেই মতামত মানা হচ্ছে না। ড্যাপে ৩০০ ফুটের দু’পাশে খাল রাখার ব্যাপারে রাজউকের কাছে কোনো স্টাডি রিপোর্টও নেই। সব কিছু পাশ কাটিয়ে কোনো ধরনের বাস্তবায়ন সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ছাড়াই খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এতে একদিকে যেমন সরকারের বিশাল আর্থিক ক্ষতি হবে, অন্যদিকে খাল খননের ভবিষ্যৎ নিয়েও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ খাল খনন এখন অবাস্তব বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের উচিত এই বিপুল অর্থ ব্যয় না করে অল্প খরচে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের দু’পাশে (কুড়িল হতে বালু নদ পর্যন্ত) ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্পটির আওতায় ৯৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া প্রায় সাত লাখ ঘনমিটার মাটি খনন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ প্রকল্পের আওতায় সেতু নির্মাণ, মাটি ভরাট, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ এবং রক্ষাপ্রদ কাজ করার কথা রয়েছে। প্রতিবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫/আপডেট: ১৩০১ ঘণ্টা
জেডএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।