ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

খুলনা প্রিন্টিংয়ের ২৭২ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৫
খুলনা প্রিন্টিংয়ের ২৭২ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি

ঢাকা: বন্ড সুবিধায় পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড ২৭২ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে ৭০০ কোটি টাকার পণ্য আমদানির মাধ্যমে এ বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।



শুল্ক ফাঁকির এ বিশাল ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন শুল্ক শাখার কিছু কর্মকর্তা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।

আদালত শুনানি শেষে রোববার (০১ নভেম্বর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনের পক্ষে রায় দেন। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে বড় ধরনের এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বন্ড সুবিধার আওতায় বিনা শুল্কে পণ্য আমদানি করা যায়, তবে সে পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করা যায় না। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের দুর্নীতির তদন্ত সম্পন্ন করা ছিল এনবিআরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন চাপের মধ্যেই এনবিআর এ তদন্ত শেষ করেছে। আদালত এনবিআরের তদন্তের পক্ষে রায় দেওয়ায় সত্যের জয় হলো।

এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এনবিআরের কিছু কর্মকর্তা খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডকে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিতে সহায়তা করেছে। এসব কর্মকর্তাকে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনতে আদালতের নির্দেশ আছে। এনবিআর আদালতের নির্দেশ মেনে দোষীদের শাস্তি দেবে।

আদালতে জমা দেওয়া শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি মেসার্স খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লি. মিথ্যা তথ্য দিয়ে বন্ড সুবিধায় পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়ম করেছে। আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে ডুপ্লেক্স বোর্ড, প্রিন্টিং পেপার, আর্ট পেপারসহ বিভিন্ন সামগ্রী।

প্রতিষ্ঠানটি খুলনার রূপসার বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন সড়কে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানের মূসক নিবন্ধন নম্বর ১৫০২১০৪০৭৪৫; বন্ড লাইসেন্স নম্বর, ০১/খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং/সুপারভাইজড বন্ড/মংলা/২০০০, তাং- ২৯.১১.২০০০। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ৭৬টি এলসির মাধ্যমে আমদানি করা পণ্য বিল অব এন্ট্রি দাখিল ব্যতিরেকে পণ্য ছাড় করে। প্রতিষ্ঠানটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং বিভিন্ন শুল্ক ভবন ও সিস্টেম থেকে যাচাইকৃত এবং প্রতিষ্ঠানের বন্ড রেজিস্টারের তথ্যানুযায়ী এক হাজার ২০৪টি চালান আমদানি করে। এর মধ্যে ৭৬টি এলসির কিছু চালান বন্ড রেজিস্টারের বন্ডারের কপিতে এন্ট্রি করা হলেও কাস্টমস কপিতে এন্ট্রি করা হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্টারে যে তথ্য রয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবে প্রাপ্ত পণ্যের পার্থক্যজনিত রাজস্ব ফাঁকি ২৫ লাখ ২০ হাজার ৪৬ টাকা। প্রচ্ছন্ন রপ্তানির ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রায় পণ্য পরিশোধিত না হওয়ায় প্রচ্ছন্ন রপ্তানির সুবিধা বাতিল হওয়ার কারণে রাজস্ব ফাঁকি ২৪৪ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪৬ টাকা। বন্ডেড সুবিধায় আমদানিকৃত অথচ বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি দেওয়া হয়নি এ রকম দু’টি চালানে রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ৩১ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৮ টাকা। এভাবে মোট রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ দু’শ একাত্তর কোটি বাহাত্তর লাখ চুয়াল্লিশ হাজার একশ টাকা।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্ত রিপোর্টে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের দুর্নীতি সম্পর্কে আরও বলা হয়, বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮ লঙ্ঘন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউসে পণ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। গুদামের ভেতর পণ্য সংরক্ষণের জন্য বন্ড লাইসেন্সের শর্ত লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। লাইসেন্স গ্রহণের পর গুদামের সংখ্যা ও মেশিনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও যথাসময়ে শুল্ক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়নি। ইচ্ছেমতো গুদাম ও মেশিনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আমদানিকৃত কাঁচামাল বিভিন্ন শুল্ক ভবন/স্টেশন হতে খালাসের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওয়্যারহাউসে আনা হয়নি।

বিবিএলসি/আইএলসি বা রফতানি এলসি/কন্ট্রাক্ট নম্বর উল্লেখ না করে, আবার কখনো এলসি ইস্যুইং ব্যাংকের স্থলে অন্য ব্যাংকের কোড নম্বর উল্লেখ করেও ইউপি দাখিল করা হয়েছে। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিবিএলসি/আইএলসি স্থাপন করে প্রচ্ছন্ন রপ্তানির অপচেষ্টা করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখার পত্র নং-খুকশা/বেবাবি/আমদানি/খুলনা প্রিন্টিং/৫৫, তারিখ-১২.১০.২০১৫ (সংযুক্তি-১৪) হতে জানা যায়, ৬টি (ছয়) মাস্টার এলসি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যাংকে দাখিল করা হয়েছে যা সঠিক নয়।

অন্যদিকে, সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেড, খুলনার পত্র নং- এসইবিএল/কেএলএন/সিআর/৩৬৪০/২০১৫, তারিখ- ১৩.১০.২০১৫ (সংযুক্তি-২৯) হতে জানা যায়, একটি মাস্টার এলসি এবং জনতা ব্যাংক লি. খান এ সবুর রোড কর্পোরেট শাখার পত্র নং-আজ/আইএলসি/শুল্ক/৫৬০/১৫; তারিখ-১৪.১০.২০১৫ (সংযুক্তি-৩০এ-৩০ডি) হতে জানা যায়, উক্ত ব্যাংকে দাখিলকৃত ৪টি (চার) আইএলসি উক্ত শাখা হতে ইস্যু হয়নি অর্থাৎ এগুলো সঠিক নয়, ভুয়া।

প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এনবিআর কর্মকর্তাদের সম্পর্কে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লি. কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রায় বিবিএলসি না করে স্থানীয় মুদ্রায় আইএলসি নম্বর উল্লেখপূর্বক আবেদন করা হলেও মংলা শুল্ক ভবনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইউপি জারির পূর্বে বিবিএলসি এবং মাস্টার এলসির সঠিকতা যাচাই করেনি। বিবিএলসির সঠিকতা যাচাই করা হলে বন্ডারের স্থানীয় মুদ্রার আইএলসির  বিপরীতে ইউপি ইস্যু হতো না। তাই এটা প্রমাণিত যে, মংলা শুল্ক ভবনের বন্ড শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্বে অবহেলা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার দায় এড়াতে পারে না।
২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ বন্ডিং মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রায় বিবিএলসি স্থাপনা না করা হলেও ইউপি ইস্যুর পূর্বে বিবিএলসি ও মাস্টার এলসির সঠিকতা যাচাই না করে ইউপি ইস্যুর মাধ্যমে বন্ডারকে ভুয়া রপ্তানিতে মংলা শুল্ক ভবনের যে সব কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। তবে অতি দ্রুত তাদের চিহ্নিত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় শাস্তির সুপারিশ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়:০৯০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৫
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।