ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ধানকাটায় শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা

‘হারা কাটারি বেচিমু মোটা চাইল কিনি খামু’

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
‘হারা কাটারি বেচিমু মোটা চাইল কিনি খামু’ ছবি: দিপু মালাকার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দিনাজপুর ঘুরে: অগ্রহায়ণ শেষে শুরু হয়েছে পৌষ মাস। এখনও জমি থেকে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ ধান কাটা-মাড়াই করছেন চাষিরা।

প্রায় ৯৫ শতাংশ ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। বাকি চাষিরা এখনও খেতের ধান সংগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।

শেষ সময়ে এসব কৃষকের ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। শুধু চাষিরাই নয়, ধান  বেচাকেনা ও সংগ্রহে চরম ব্যস্ত ফড়িয়া আড়তদার, ছোট চালকল ও বড় চালকল মালিকদেরও যেন ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

দিনাজপুরের রামসাগর খানপুরে বিশাল মাঠজুড়ে দেখা গেছে কাটারিভোগ ধান কাটা-মাড়াইয়ে কৃষকের ব্যস্ততা। খানপুরের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে ধান কাটায় ব্যস্ত চাষি শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বললেন, ‘কাটারিভোগ আবাদ করি ঠিকই, খাওয়া পারি না। দাম বেশি! সরু চাইলের (চাল) কেজি ৮০ ট্যাকা। সরু চাইল বিককির (বিক্রি) করে মোডা চাইল খাই। হারা কাটারি বেচিমু, মোটা চাইল কিনি খামু। সরু চাইল প্যাটোত (পেটে) থাকে না। মোটা চাইল বেশি সুম (সময়) প্যাটোত থাকে। হজম হয় কম, ট্যাকাও বাঁচে। সরু কাটারি বড় লোকে খাবে, হারা খাওন যাই না’।

দিনাজপুর সদর উপজেলার ফাশিলাহাট, ছোট বাউল, বড় বাউল, করিমুল্যাপুর ও খানপুর, চিরিরবন্দর উপজেলার কাউগাঁ, বিষ্টপুর, তালপুকুর মুকুন্দপুর, দুর্গাডাংগা, ভিয়াইল ও পশ্চিম বাউল এবং কাহারোল উপজেলার দু'একটি উঁচু জায়গায় এ বিশেষ জাতের ধান আবাদ হয়।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, চাষিরা বিখ্যাত কাটারিভোগ ধানের আবাদ করেন ঠিকই, কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন চাষি এ ধানের ভাত খেতে পান। বেশিরভাগ চাষি কাটারিভোগ ধান বিক্রি করে দিয়ে মোটা চালের ভাত খাই। অর্থনৈতিক দৈন্যতা ছাড়াও আরও একটি কারণেও তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে দেন এসব চাষিরা।   তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয় সব সময়। যে কারণে কাটারিভোগের ভাত খেলে দ্রুত হজম হয়ে যায়। এ কারণে সরু চালের এই ধান বিক্রি করে মোটা চাল কিনে খান তারা, যেন মোটা চালের ভাত খেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে পারেন।

কাটারিভোগ ধানের চাল সবার কাছে প্রিয় হলেও তাই উৎপাদকদের কাছে নয়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বিঘা প্রতি কাটারিভোগ ধানের ফলন হয় ৭ থেকে ৮ বস্তা (প্রতি বস্তা ৯০ কেজি)। প্রতি বস্তা ২৮শ’ টাকা থেকে ২৯ শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ধান লাগানো, সেচ, সার ও কীটনাশকসহ বিঘাপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। চাষিরা কাটারিভোগ ধান লাগানো থেকে শুরু করে চার মাসে ঘরে তুলতে পারেন। অন্যদিকে কাটা-মাড়াই করার জন্য আরও দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে হয়।

এতে করে বিঘাপ্রতি ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করে কাটারিভোগ ধান উৎপাদন করা যায়। খরচ বাদ দিয়ে বিঘাপ্রতি গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা চাষির হাতে থাকে। ধান ‍কাটার পর কিছুদিন জমিতে বিচালিসহ শুকাতে দেওয়া হয়। এরপর ধানের বিচালি লাঠির দু’পাশে বেধে বহন করে বাড়িতে আনা হয়।

ফাশিলাহাটের কাটারিভোগ ধানচাষি মিজানুর বাংলানিউজকে বলেন, ‘যারা আবাদ করে তারা মইয়ায় (ভালোবাসা) কাটারি খাওয়া পারে না। তারা মোটা চাল খায় সরু বিক্রি করে’।

এখন দিনাজপুর সড়কের যেদিকেই তাকানো যাবে, সেদিকেই দেখা যাবে ভালোবাসার কাটারিভোগ ধান নিয়ে বাজারে ছুটছেন চাষিরা। এসব ধান সংগ্রহ করছে হাসকিং মিল, বড় চালকল ও আড়তদাররা। আড়তদাররা আবার বড় ট্রাক নিয়ে ছুটছেন বড় চালকল বা অটোকলের দিকে। উত্তরবঙ্গের মধ্যে কাটারিভোগের অন্যতম বড় মার্কেট দিনাজপুরের পাইকারি বাজার শহরের রেলবাজার, বাহাদুর বাজার ও পুলহাট।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে,  এসব চালকল দুই মণ (৯০ কেজির বস্তা) কাটারিভোগ ধান ২৮শ’ টাকা থেকে ২৯শ’ টাকায় কিনছে। অন্যদিকে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) কাটারিভোগ চাল বিক্রি করছে ৩২শ’ টাকা থেকে ৩৩শ’ টাকায়। দিনাজপুর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে ছড়িয়ে পড়ছে সবার প্রিয় কাটারিভোগ ধানের চাল।

দিনাজপুর বিসিকের কাছের পুলহাটেও কাটারিভোগ ধান সংগ্রহ ও কাটা-মাড়াই নিয়ে চাষিদের আর ধান বেচা-কেনা নিয়ে চালকলগুলোর ব্যস্ততা দেখা গেছে।

সেখানকার ছোট চালকল ফুয়াদ ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজার জিয়াউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে প্রায় ৯৫ শতাংশ কাটারিভোগ ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়। পৌষ মাসজুড়ে আমরা এ ধান সংগ্রহ করে থাকি। তবে একমাস পরে চাষিদের কাছে আর কাটারিভোগ ধান থাকে না। তখন আমরা আড়তদারের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করি। পরে সংগ্রহ করা কাটারিভোগ ধান থেকে চাল তৈরি করে বিক্রি করি।

দিনাজপুরে ছোট ও বড় মিলিয়ে ৩ থেকে ৪শ’ চালকল রয়েছে। ছোট ছোট চালকলগুলো উঠানে ধান শুকানো নিয়ে ব্যস্ত। এখানেও হাজারো শ্রমিক কর্মরত। শ্রমিকদের গড়ে প্রতিদিন আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
এমআইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।