ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

টেংরার পর এবার গুতুম রেণু উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
টেংরার পর এবার গুতুম রেণু উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে ব্রুড প্রতিপালন পোনা উৎপাদনে সংগৃহিত গুতুম মাছ/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নীলফামারী: বিলুপ্তপ্রায় গুতুম মাছের রেণুপোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জনের পথে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের নীলফামারীর সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপ-কেন্দ্র। টেংরার রেণুপোনা উৎপাদন, প্রযুক্তি ও কলাকৌশল উদ্ভাবনের পর নিরন্তর গবেষণা করে এ কাজেও সফল হতে চলেছেন প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা।

ক্যান্সার প্রতিরোধক বউ মাছ, খলিশা, রানী চ্যাঙ, শোল, টাকিসহ অন্য ৬৫ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ নিয়েও গবেষণা অব্যাহত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

গুতুম মাছ বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তানের স্থানীয় মাছ।

নদীর অববাহিকায় এদের বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশে চলনবিল, ছোট যমুনা নদী, হালতি বিলে এ মাছ পাওয়ার তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে। ময়মনসিংহ, সিলেট, দিনাজপুর ও রংপুরের ছোট ছোট নদী থেকেও সামান্য পরিমাণে মিলছে।

পুরোপুরি বিলুপ্ত না হলেও নদী, খাল-বিল, জলাশয়ে আগের মতো আর মিলছে না গুতুম মাছ।

সরেজমিনে জানা গেছে, স্বাদুপানি উপ-কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বিলুপ্ত প্রজাতির টেংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরুপ জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ’১৭- এ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রৌপ্য পদক অর্জন করেন তারা।

পুরস্কার লাভের পর কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শওকত আহম্মেদ গুতুম মাছসহ বিলুপ্ত ৬৫ প্রজাতির মাছ নিয়ে গবেষণার কাজ জোরেশোরে শুরু করেন।
গুতুম মাছে হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে এবং বের করে আনা হচ্ছে ডিম/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমপ্রথমে প্রাকৃতিক উপায়ে গুতুম মাছ সংগ্রহ করে স্বাদুপানির পুকুরে ছেড়ে পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ান তারা। চলে নিবিঢ় পর্যবেক্ষণসহ গবেষণার কাজ। তারপর হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে গুতুম মাছে ব্রুড প্রতিপালন ও পোনা উৎপাদন করা হয়। এরপর রেণুপোনা উৎপাদন করে ৭/৮ দিনের মধ্যে পুকুরে ছাড়া হয়।

বিজ্ঞানীরা জানান, তলদেশি মাছটি পোকা-মাকড়ের শুক্রকীট, গলিত ও পচা খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। ৮ থেকে ১২ মাসের মধ্যে খাবারের উপযোগী হয়ে ওঠে। এ কেন্দ্রে এ পর্যন্ত ৯ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার সাইজের গুতুম মাছ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে মাছটিকে মূলত খাবারের মাছ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাহারি মাছ হিসাবেও চাহিদা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাছটি ছোট আকারের হলেও ডিম ধারণ ক্ষমতা অনেক। প্রাথমিক গবেষণায় ১০ হাজার থেকে ২২ হাজার ডিম পাওয়া গেছে।

মাছটির দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেহ পার্শ্বীয়ভাবে সামান্য চাপা ও সাধারণত গাঢ় হলুদ বর্ণের। আঁশ ছোট ও সুস্পষ্ট এবং মিউকাসে আবৃত। গুচ্ছ পাখনা ও পৃষ্ঠ পাখনায় রেখার মতো দাগ রয়েছে। এই জনপদে গুতুম মাছ গুটিয়া, গোরকুন, পোয়া, পুইয়া, গোতরা বা পুয়া মাছ নামেও বেশি পরিচিত।

পরিণত পুরুষ গুতুম মাছের দীর্ঘ বক্ষ পাখনার ৭ম ও ৮ম পাখনা রশ্মি একীভূত হয়ে ল্যামিনা সার্কুলারিস নামক গঠন দেখতে পাওয়া যায়, যা স্ত্রী মাছে অনুপস্থিত। বক্ষ পাখনা স্ত্রীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি হয়ে থাকে। একই বয়সের পরিণত স্ত্রীরা পুরুষের চেয়ে স্ফীত, সামান্য লম্বা হয়ে থাকে। যাদের পেটের সামনে দাগ দেখতে পাওয়া যায়। এরা প্রকৃতিতে একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে প্রজনন করে থাকে। এদের প্রজম্মকাল জুলাই- সেপ্টেম্বর মাসে চিহ্নিত করা হয়েছে।

স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে রেনুপোনা থেকে উৎপাদিত গুতুম মাছ/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপ-কেন্দ্রের প্রধান ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্বেও কেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। টেংরার পর গুতুম মাছের ব্রুড প্রতিপালন ও পোনা উৎপাদনেও সফলতা এসেছে। দেশে-বিদেশে এটি অর্থনৈতিক সাফল্য বয়ে আনবে বলেও মনে করেন তিনি।

ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদের সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শে এ সফলতা এসেছে বলে উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান।

সাম্প্রতিক বন্যায় স্বাদুপানি উপ-কেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও পুকুরগুলোর মাছ এলোমেলো হয়ে গেছে। সবকিছু ঠিকমতো গুছিয়ে নিয়ে গুতুম মাছের পোনা উৎপাদনের কলাকৌশল ও প্রযুক্তি আগামী বছরের জানুয়ারিতে ইন্সটিটিউটের কাছে হস্তান্তরের আশা করছেন তিনি।

গবেষণা ইন্সটিটিউট হয়ে মৎস্য অধিদফতরে গুতুম মাছের রেণুপোনা উৎপাদন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের পর সারাদেশে তা ছড়িয়ে পড়বে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বর্তমানে এ কেন্দ্রে ৩ জন কর্মকর্তা ও ২০ জন কর্মচারী কর্মরত। বৈজ্ঞানিকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কর্মচারীদের আন্তরিকতায় একের পর এক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের ওপর গবেষণা করে ফিরিয়ে আনায় সকলের দৃষ্টিতে এসেছে স্বাদুপানি উপ-কেন্দ্রটি।

স্থানীয়রা বলছেন, উপ-কেন্দ্রটিকে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রে পরিণত করা প্রয়োজন। এর ফলে অবকাঠামোগত সুবিধা ও ল্যাবরেটরিসহ জনবল বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।