ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

শাস্তির পরও বেপরোয়া বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীরা 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০১ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৯
শাস্তির পরও বেপরোয়া বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীরা 

দ্রুত ও সহজে পোশাক রফতানির জন্য রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বন্ড সুবিধা দিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু এ সুবিধার অপব্যহার করছে একটি অসাধু চক্র। রফতানিমুখী শিল্পের কথা বলে ট্রাকে ট্রাকে আনা শুল্কফাঁকির পণ্য যাচ্ছে কালোবাজারে। এতে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় শিল্পখাত, তেমনি সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে। এই কালোবাজারি নিয়ে বাংলানিউজের অনুসন্ধানের ওপর তিনটি প্রতিবেদনের আজ পড়ুন শেষ প্রতিবেদন

খুলনা: বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির কারণে কাস্টমসের হাতে ধরা খেয়ে শাস্তি পেলেও বেপরোয়া খুলনাঞ্চলের অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। রফতানিমুখী শিল্পের কথা বলে আনা শুল্কফাঁকির পণ্য অবৈধভাবেই খোলাবাজারে বেচে চলেছে তারা।

এ দুর্নীতির মাধ্যমে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী লাভবান হলেও সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রুখতে হবে কালোবাজারিদের।  

** বন্ডেড পণ্য কালোবাজারে, অসাধু চক্রকে রুখবে কে?

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোংলা বন্দর দিয়ে বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে যেসব প্রতিষ্ঠান সেগুলো হলো- খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেড, বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, শরীফা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, সাউথ এশিয়ান প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। এর মধ্যে প্রথম তিনটি লকপুর গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম আমজাদ হোসেন। অপর দু’টির এমডি মাহমুদ হাসান টিটো।

এছাড়া ছোট আকারের কিছু প্রতিষ্ঠানও বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মৌলি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, বেঙ্গল প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, র‌্যাপিড প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, সাউথ ওয়েস্ট প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

** চট্টগ্রামের কাগজের বাজারে অস্থিরতার নেপথ্যে বন্ডেড পণ্য

বন্ড সুবিধা নিয়ে খুলনাঞ্চলে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাগজ আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে- খুলনার রূপসা উপজেলার বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন সড়কের খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, মহানগরীর পশ্চিম রূপসা এবি ফিসের পাশে অবস্থিত বেঙ্গল প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, খুলনা মহানগরীর ফরাজিপাড়ায় অবস্থিত শরীফা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সাউথ এশিয়ান প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড,  মৌলি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, বেঙ্গল প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড উল্লেখযোগ্য।

খুলনার চিংড়ি রফতানি কাজে ব্যবহৃত প্যাকেজিংয়ের বিবিধ আমদানি করা পণ্য বন্ডেড ওয়ারহাউস ব্যবহারের সুযোগ পায়। এই সুযোগের অপব্যবহার করে প্রয়োজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পণ্য আমদানি করে কোম্পানিগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করে বলে বিস্তর অভিযোগ আছে।

বিধিমতে, আমদানি করা এসব পণ্যের শুল্ক পরিশোধ না করেই আমদানিকারকরা গুদামজাত করতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে, এসব পণ্য দেশের খোলা বাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব চিংড়ি রফতানির কাজেই ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সব পণ্য চিংড়ি রফতানির কাজে ব্যবহার না হয়ে খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

নানা অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকায় কয়েকবছর আগে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের বন্ডেড ওয়ারহাউসের লেনদেন সাময়িক বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট এনবিআরের তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেন। খুলনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিল্পপতির প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা নিয়ে সেই সময় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

যদিও ভবিষ্যতে নিয়ম পরিপালনের শর্তে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের গুদাম, বন্ড লাইসেন্স ও বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (বিআইএন) পরে খুলে দেয় এনবিআর। প্রায় দুই বছর পর তাদের কারখানায় আবার পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়।

তাছাড়া, ২০১৭ সালে বন্ডেড ওয়ারহাউসের সুবিধা নিয়ে আমদানি করা আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুল্কফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ এনে তা পরিশোধের দাবি করে মোংলা কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ। এমন শাস্তি অন্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠানকেও পেতে হয়।  

তারপরও অনুসন্ধান বলছে, খুলনার শঙ্খ মার্কেটের কামাল স্টেশনারি, খুলনা সদর থানার মোড়ে শরীফ জেনারেল, পিকচার প্যালেস মোড় সংলগ্ন আরাফাত গলিতে ডুকে বাম দিকে আজিজ প্রেসসহ খুলনার বড় বড় প্রেসে গোপনে বন্ডেড কাগজ বিক্রি হয়। এছাড়া কিছু কাগজ মোংলা থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। তাদের বন্ডেড কাগজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সুইডিশ বোর্ড, কোরিয়ান বোর্ড, আর্ট কার্ড, রিয়েল আর্ট পেপার।

যোগাযোগ করা হলে মোংলা ইপিজেডের এসি মো. পারভেজ আল জামান বাংলানিউজকে বলেন, বন্ড সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে কাগজ আনে খুলনাঞ্চলের ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।

মোংলা বন্দরের এক প্রকৌশলী ও ট্রাফিক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে এ বিষয়ে বলেন জানান,  ইপিজেডে পণ্য উৎপাদনে সরাসরি সংশ্লিষ্ট কাঁচামালসমূহ সরকারের ট্যাক্সমুক্ত ঘোষণার আওতাধীন। মোংলা ইপিজেডের ভেতরে কাস্টমসের একজন সহকারী কমিশনার (এসি) ও একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট এসব কোম্পানির আমদানি করা কাঁচামালগুলি পরীক্ষা করে থাকেন।

মোংলা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, মোংলায় বন্ড সুবিধা নিয়ে পাঁচটি বড় প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি করে। এছাড়া আরও ৮টি ছোট আকারের প্রতিষ্ঠানও বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটা বন্ধ ও দেওলিয়াত্বের পথে রয়েছে।  

তিনি বলেন, পণ্য আমদানিতে বন্ডের সুবিধা নিয়ে যারা এর অপব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় সতর্ক রয়েছি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ও সিলগালা করা হয়েছে। আদালত থেকে পরবর্তীতে ভবিষ্যতে নিয়ম পরিপালনের শর্তে আবার প্রতিষ্ঠান চালু করেছে কেউ কেউ।

বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) খুলনা শাখার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যারা বন্ডের সুবিধা নিয়ে অপব্যবহার করেন তাদের বিরুদ্ধে এনবিআরকে আরও কঠোর হতে হবে। এ ধরনের গর্হিত কাজ যারা করছেন তাদের স্বরূপ উন্মোচিত করতে হবে।

আনোয়ারুল কাদির আরও বলেন, সরকার বন্ড সুবিধা যে কারণে দেয় তার যদি অপব্যবহার করা হয় তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশীয় শিল্পখাত, সরকার হারায় রাজস্ব। বিষয়টি রোধ করতে একটি মনিটরিং সেল করতে হবে।  

বাংলাদেশসময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৯
এমআরএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।