ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৪ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২১
স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে

ঢাকা: বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনা মহামারির ধাক্কা প্রাথমিকভাবে কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও তা সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সমান নয়। প্রান্তিক-ক্ষুদ্র এবং ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে আর্থিক এবং মানসিকভাবে এই সমস্যার প্রভাব এখনও বিরাজমান অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ এই খাতেই কর্মরত এবং বাংলাদেশের জিডিপির এক চতুর্থাংশ অর্জনে এই খাতগুলোই ভূমিকা রাখে।

সোমবার (৩১ মে) ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং অস্ট্রেলিয়ার মনাশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তিক/ ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর করোনা মহামারির প্রভাব নিয়ে মোবাইলভিত্তিক জরিপের ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ছিল লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান এবং ১৬ শতাংশ ছিল সেবাখাত যেমন দর্জি কিংবা বিউটি পার্লার। জরিপে দেখা গেছে, নারী কর্মী আছে এবং উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকি বিদ্যমান এমন প্রতিষ্ঠান যেমন বিউটি পার্লার মহামারির ধাক্কা সামলে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল।

মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যান্ড সাস্টেইনাবিলিটি (সিডিইএস)-র পরিচালক, প্রফেসর আসাদ ইসলাম এবং বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট আতিয়া রহমান জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন।

সব মিলিয়ে দ্বিতীয় লকডাউনের ঠিক আগমুহূর্তে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাপূর্ব সময়ের মতো অবস্থানে ফিরে এসেছে, যদিও ৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই আবার তাদের ব্যবসা শুরু করেছে।

বিশেষত এই ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অনেক ঝুঁকিতে থাকে। ২০২০ সালের জুনে পুরুষ কর্মীদের বেকারত্বের হার প্রথম লক ডাউনের তুলনায় ১৫ শতাংশ কমলেও এটি এখনও অপরিবর্তিত আছে। নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে বরং গত জুনের পর বেকারত্ব আরও বেড়ে ৫৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রথম লকডাউন স্থগিত হওয়ার আট মাসপর, লকডাউন পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় নারীদের আয় ৫৬ শতাংশ এবং পুরুষদের আয় ২৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে দেখা গেছে। একইসঙ্গে কর্মহীন নারীদের মানসিক চাপ মহামারীকালীন সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারি বাড়তে থাকা সত্ত্বেও কর্মীদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন  ২০২০ সালের জুনের পর থেকে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, যা তাদের প্রবল স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলেছে।

ড. ইমরান মতিন, নির্বাহী পরিচালক, বিআইজিডি উল্লেখ করেন, পুনরায় চালু এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার যে ব্যাপারটি প্রচারিত হয়েছে তা এক্ষেত্রে একটু জটিল। কারণ, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো যারা বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে মহামারীর প্রবল আঘাত তাদের ওপরেই বেশি লেগেছে।

৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আবার চালু হলেও সেবা খাত যেমন বিউটি পার্লার এবং কসমেটিকস, কাপড় এবং দর্জি, মুদি দোকান, গ্রিল ওয়ার্কশপ এবং রেস্টুরেন্টগুলোর বিক্রি কোভিড-পূর্ব সময়ের চেয়ে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। যেসব বিউটি পার্লার এবং কসমেটিকসের দোকান নারী মালিকানাধীন এবং নারী কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত, সেগুলোর বিক্রি কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় ৫৭ শতাংশ কমেছে।

প্রথম লকডাউন স্থগিতের আট মাস পরেও অর্ডার কমে আসায় উদ্যোক্তারা বেশ চিন্তিত। কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি উদ্যোক্তা, বিশেষত যারা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ব্যাপারটি এই খাতে সাপ্লাই চেইন সংক্রান্ত বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণের গুরুত্বকেই নির্দেশ করে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন দেওয়া নিয়েও চিন্তিত।

২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের এক চতুর্থাংশ এসেছে এনজিও থেকে, এবং পরিবার কিংবা বিশ্বস্ত কারও কাছ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেওয়া হয়েছে। সরকারি সহায়তা পেয়েছেন মাত্র চার শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ থাকলেও মাত্র ছয় শতাংশ ব্যবসায়ীর আবেদনের বিপরীতে এক শতাংশ এই সুবিধা পেয়েছে। আবেদনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে লম্বা আবেদন প্রক্রিয়া এবং ব্যাংকিং ইস্যুকে তুলে ধরেছেন আবেদনকারীরা। তবে জরিপের অংশ নেওয়া অর্ধেকেরও বেশি অংশগ্রহনকারী যারা প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানেন কিন্তু আবেদন করেননি, তারা ভবিষ্যতে আবেদন করতে আগ্রহী।

নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্যোক্তাদের ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে হলে তাদের সঠিক স্বাস্থ্যবিধি এবং পর্যাপ্ত সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষকরা। কায়িক শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। সর্বাঙ্গীন প্রশিক্ষণ এবং অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে এমন নিরাপত্তা বলয় নারীদের বেকারত্ব থেকে মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হতে পারে বলে গবেষকরা জানান। তারা আরও জানান, সরকারি প্রণোদনার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা আবেদনের সময় পরিলক্ষিত হয়নি। আবেদন প্রক্রিয়া সহজ হলে এবং সচেতনতা বাড়ানো গেলে প্রণোদনা পাওয়ার জন্য অনেকেই আবেদনে আগ্রহী হবেন।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব লুৎফুন নাহার বেগম বলেন, প্রণোদনা গ্রহণের হার জনগণের মধ্যে কম থাকা সত্ত্বেও সরকার ১ দশমিক ২৪ ট্রিলিয়ন টাকার ২৩ ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ হাতে নিয়েছে।

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভলপমেন্টের (বিল্ড) সিইও ফেরদৌস আরা বেগম, বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের একটি বড় ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মনজুর হোসেন বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ কেমন হবে ও কিভাবে তা বন্টন করা হবে সে ব্যাপারে সরকার এনজিওগুলোকে যুক্ত করতে পারে। কারণ এনজিওগুলো ক্ষুদ্র শিল্পে এ ধরনের সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা রেখে আসছে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৪৯ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২১
এসই/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।