ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

নরসিংদীতে অম্লমধুর লটকন এনেছে কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪২ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২১
নরসিংদীতে অম্লমধুর লটকন এনেছে কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঝুড়ি ভর্তি লটকন। ছবি: বাংলানিউজ

নরসিংদী: এক সময়ের কদরহীন লটকন এখন বর্ষা মৌসুমের অন্যতম জনপ্রিয় ফল। লটকনের জন্য বিখ্যাত নরসিংদী জেলার বাগানগুলো এখন লটকনে লটকনময়।

এই জেলার উৎপাদিত লটকন আকারে বড়, দেখতে হলদে মসৃণ আর স্বাদে সুমিষ্ট হওয়ায় দেশবাসীর পাশাপাশি বিদেশিদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছে।

চলতি মৌসুমে ১৬৮ কোটি টাকার লটকন বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। তবে, এবার অনাবৃষ্টিতে লটকনের ফলন হয়েছে কম। এদিকে মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে অনেকটা পাল্টে গেছে এই চিত্র। এছাড়া বাগান মালিকরা কিছুটা লাভবান হলেও বিভিন্ন যানবাহন ও রপ্তানি বন্ধ থাকায় দুই বছর ধরে লোকসান গুনছেন লটকন ব্যবসায়ীরা।

উঁচু আর লালমাটির টিলা লটকন চাষের জন্য উপযোগী ভূমি। জেলার সর্বত্র কমবেশি লটকনের ফলন হয়। এ বছর জেলায় ১ হাজার ৬শ ১০ হেক্টর জমিতে লটকনের আবাদ হয়েছে। লটকনের স্বাদ অম্লমধুর এবং পুষ্টিমান প্রচুর। ওষুধিগুণ সম্পন্ন সুস্বাদু লটকন ডায়াবেটিস, প্রেসার নিয়ন্ত্রণসহ রুচি বর্ধক ফল হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এর চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ।  প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর লটকন আবাদ করে স্বাবলম্বী নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার অনেক কৃষক। ইতোমধ্যে এসব এলাকাবাসীর কাছে লটকন এখন অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ লাভ বেশি হওয়ায় লটকন চাষে ঝুঁকে পড়ছেন কৃষকরা। তবে, এ বছর অনাবৃষ্টি আর খরার কারণে লটকনের ফলন কম হয়েছে। বাজারে আকারভেদে প্রতিকেজি লটকন বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত।

নরসিংদী জেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার লাল মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান।  তাই এখানে লটকনের ভালো ফলন হয়।

চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৬শ ১০ হেক্টর জমিতে লটকনের বাগান করা হয়েছে। যা হেক্টর প্রতি ১৫ টন হারে ২৪ হাজার মেট্রিক টন লটকনের ফলন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ।

আর উৎপাদিত এ লটকন পাইকারী ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মূল্য পাওয়া যাবে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক চাষ ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও পতিত জমিতেও লটকন গাছ রয়েছে যা কৃষি বিভাগের হিসেবের অর্ন্তভুক্ত নয়। নরসিংদীর পাশাপাশি সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাজীপুর জেলায়ও লটকনের চাষ হচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক এর বেশ কিছু স্থানীয় নাম রয়েছে। চট্টগ্রামে এর নাম হাড়ফাটা, সিলেটবাসী চেনে ডুবি নামে, ময়মনসিংহে বলে কানাইজু। আঙ্গুরের মতো ধরে বলে ইংরেজিতে এর নাম  Burmese grap। বৈজ্ঞানিক নাম  Baccaurea sapida

নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার বিশাল অঞ্চল লালমাটির টিলাময়। গ্রামের ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে ছায়াঘেরা লটকন বাগান। বাগানের অধিকাংশ গাছের গোড়া থেকে উপরি অংশের শাখা-প্রশাখায় লটকন জড়িয়ে আছে। দেখতে মনে হয় যেন পুরো গাছে লটকনের ফুল ফুটছে। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে গাছে পাকা লটকন দেখে জীবে জল এসে যেতে পারে।

শিবপুরের চৈতন্যা গ্রামের শামীম মিয়া বলেন, লটকন গাছ সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে রোপণের উপযুক্ত সময়। বর্ষার শেষের দিকে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়। লটকনের গাছ লাল মাটিতে ঝোপের মতো হয়ে থাকে। প্রতিবছর মাঘ-ফাল্গুনে লটকন গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে এ ফল পরিপক্কতা পায়। এটি চাষে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈব সার দিলে ফলন ভালো হবে। পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের হাত থেকে ফল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়। শিবপুরের কামারগাঁও গ্রামের হাফিজ মিয়া বলেন, এবার অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে লটকনের ফলন কম হয়েছে। সময় মত পানি না পাওয়ার কারণে লটকনের আকার ও ছোট হয়ে গেছে। তবে, ফলন কম হলে ও বাজারে লটকনের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।

বেলাব উপজেলার লাখপুর গ্রামের বাগান মালিক মানিক মোল্লা বলেন, লটকন ফল বিক্রির ভাবনা ভাবতে হচ্ছে না তাদের। স্থানীয় বাজার ছাড়াও লটকনের ফল ধরার পর বাগান বিক্রি করে দেওয়া যায়। পাইকাররা বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দুই একর জমিতে লটকন বাগান করেছেন। এ বছর একটি লটকন বাগান ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা এবং আরেকটি বাগান ৩ লাখ ১০ হাজার টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।

এদিকে করোনায় শিক্ষিত বেকাররা বাড়িতে বসে না থেকে লটকন চাষ করছেন। লটকন চাষ সহজ হওয়ায় ও বাজারের এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় তারা লটকন চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুষার আহমেদ বলেন, করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। কোনো কাজ না থাকায় বাড়িতে বসে অলস সময় পার করছিলাম। এবার আর অলস বসে না থেকে বাড়ির খালি জায়গায় লটকন চাষ করেছি। আশানুরুপ ফলন না হলেও আমি আশাবাদী সামনের বছর ভালো কিছু করতে পারবো। তবে, মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে চলমান লকডাউনের ফলে বিক্রির আশঙ্কায় বাগান খরিদ করা পাইকারী ব্যবসায়ীরা অনেক তড়িঘড়ি করেই গাছ থেকে লটকন তুলে নেয়। স্থানীয় পাইকারী বাজারগুলোতে ক্রেতার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন আড়তগুলোতে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পাইকারী ব্যবসায়ীরা। ফলে লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বাগান খরিদ করা পাইকারী ব্যবসায়ী হারিছ মিয়া বলেন, এ বছর আমি ধার-দেনা করে ৭ লাখ টাকায় ৩টি বাগান কিনেছি। শুরুর দিকে ভালো দাম পেলেও এখন এর অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফল নিয়ে ঢাকা নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু ফেরার সময় রাস্তায় অনেক ঝামেলা হয়। এ অবস্থায় হিসেব করলে দেখা যাবে প্রায় তিন থেকে আড়াই লাখ টাকা লোকসান দিতে হবে আমাকে। ধারে টাকা কিভাবে শোধ করবে সেই এখন আমার দুঃচিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাগান থেকে লটকন কিনতে আসা ফরিদ হোসেন নামে অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, শুরু দিকে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা মণ ধরে বিক্রি করতে পারলেও চলমান লকডাউনের কারণে তা বিক্রি করতে হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায়।  তাছাড়া পরিবহন খরচও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আগে হকাররা লটকন বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে তারা বেরুতে পারছেন না। আমরা লাভ নিয়ে শঙ্কায় আছি।

এদিকে চলতি মৌসুমে এ ফলের বেচাকেনাকে ঘিরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল, বেলাবরের বাড়ৈচা, পলাশের রাবান ও শিবপুর উপজেলা সদরে ও যোশরে বসছে লটকনের পাইকারী বাজার। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারী ক্রেতারা এসে এসব বাজার থেকে কিনে নিয়ে যায় লটকন। পর্যায়ক্রমে হাত বদল হয়ে লটকন যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বাজারে।  

সিলেট থেকে লটকন কিনতে বাড়ৈচা বাজারে এসছেন ফল ব্যবসায়ী অমিত দাস। তিনি বলেন, নরসিংদীর লটকন খুবই সুস্বাদু। বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছরই লটকন কিনতে আসি। তাই এবার লটকন কিনতে এসেছি।

নরসিংদী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা কিশোর কুমার সাহা বলেন, করোনার কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও কৃষি দ্রব্যাদির যানবাহনে চলাচলে কোনো বাঁধা নেই। আমরা দেশের যেকোনো স্থানে লটকন সরবরাহ করতে প্রস্তুত রয়েছি। নিরবচ্ছিন্নভাবে যাতে সরবরাহ করা যায় তার জন্য আমরা কৃষক ও পাইকারদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের একটি স্টিকার দেওয়া শুরু করেছি। এই স্টিকারটি কোনো যানবাহনে লাগানো থাকলে সড়ক-মহাসড়কে তারা কোনো হয়রানির শিকার হবে না। নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শোভন কুমার ধর বাংলানিউজকে বলেন, লটকন চাষ বাড়াতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারে রপ্তানি হওয়াতে কৃষকরা লটকনের ন্যায্যদাম পাচ্ছেন। চলতি মৌসুমে লটকনের মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৪ হাজার মেট্রিক টন। যার পাইকারী ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি মূল্য দাঁড়ায় ১৬৮ কোটি টাকা।

তিনি আরও বলেন, নরসিংদীতে এখন কোনো হিমাগার নেই। হিমাগার থাকলে লটকনের বহুমুখী ব্যবহার করা যেতো এবং লটকনের মূল্য বাড়তো। আমি সরকারের কাছে জোরদাবি জানাচ্ছি নরসিংদীতে একটি হিমাগার অতি প্রয়োজন। এখানে একটি হিমাগার স্থাপন হলে স্থানীয় ফলের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সবজি, লেবু সংরক্ষণ করা গেলে কৃষকরা অনেক লাভবান হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪২ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২১
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।