ঢাকা: চলতি বছরের মাঝামাঝি ইভ্যালির কর্মচারীদের বেতন বন্ধ থাকলেও রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন পদাধিকার বলে মাসে পাঁচ লাখ টাকা করে বেতন নিতেন। তিনি ও তার স্ত্রী ইভ্যালি থেকে কেনা অডি ও রেঞ্জ রোভার গাড়ি নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতেন।
শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর গুলশান থানায় দায়েরকৃত একটি মামলার প্রেক্ষিতে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল, তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইভ্যালি লোকসানি কোম্পানি, তারা কোনো ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করা হতো। ফলে দেনা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। ইভ্যালির ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল নতুন গ্রাহকের কাঁধে দায় চাপিয়ে পুরাতন গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের কিছু কিছু অংশ পরিশোধ করা। অর্থাৎ দায় ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল ইভ্যালি।
বিপুল পরিমাল গ্রাহক তৈরি করে ইভ্যালির একটি ব্র্যান্ডভ্যালু তৈরির পরিকল্পনা ছিলো রাসেলের। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেতে চেয়েছিলেন। এরপর বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে এটি বিক্রি করে দেয়ার টার্গেট ছিলো তার।
রাসেলের অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে নিজের কোম্পানির শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপিয়ে দেওয়া। এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোরও পরিকল্পনা নেন।
তিনি জানান, দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বৃদ্ধির আবেদন ছিলো রাসেলের একটি অপকৌশল মাত্র। সর্বশেষ তিনি দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে দেওলিয়া ঘোষণারও পরিকল্পনা করেছিলেন।
এ র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে সাভারে রাসেলের ৭-৮ কোটি টাকা মূল্যের জায়গা-জমিসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে ৩০-৩৫ কোটি গ্রাহকের টাকা আটকে আছে, অর্থাৎ সেসব টাকা কোম্পানির নয়।
ইভ্যালি পরিকল্পিতভাবে একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতার ফলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্তার সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে সক্ষম হননি রাসেল ও তার স্ত্রী।
তার এ কার্যক্রমের পেছনে কারো সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘ইভ্যালি কোম্পানি, ইট ওয়াজ ওয়ান ম্যান সো। ইট ওয়াজ রাসেল, ইটসেলফ’। নিজস্ব বিচার বিবেচনায় সব করতেন। গ্রাহকরা যখন দীর্ঘদিন পণ্য পাচ্ছিল না তখন টি১০, টি৭, টি৫ অফার চালু করেন। এ অফারগুলোর মাধ্যমে সাধারণ পণ্য টুথপেস্ট, টুথব্রাশ ফেরত দিয়ে আসছিলেন। গত ফেব্রুয়ারির পর তিনি বড় কোনো পণ্য ফেরত দিতে পারেননি। বিভিন্ন জনের সঙ্গে সম্পর্ক, স্পন্সর করা- এটা ছিল তার মার্কেটিং পলেসি। তিনি ইভ্যালিকে দক্ষিণ এশিয়ার এক নম্বর কোম্পানি করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের লগ্নি করা টাকায় তিনি এসব করেছেন।
ইভ্যালি শুরু থেকেই লোকসানি প্রতিষ্ঠান ছিলো। ২০১৭ সালে শিশুদের ব্যবহার্য জিনিষের একটি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে ১ কোটি টাকা পায়। সেই যৎসামান্য অর্থ দিয়ে ইভ্যালি যাত্রা শুরু করে। অফিসসহ অন্যান্য ব্যয় মিলে প্রতি মাসে প্রায় ৫ কোটি টাকা বহন করতে হয়েছে। যে সব স্ট্র্যাটেজিতে ব্যবসা করেছে তাতে ইভ্যালি কোনো লভ্যাংশ পায়নি।
সব গ্রাহককে তারা পণ্য দিতেন না। ১০০ জনের মধ্য ৫-১০ জন পুরাতন গ্রাহককে পণ্য দিতেন, নতুনদের দিতেন না। কীভাবে দেনা পরিশোধ করবেন- তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।
ইভ্যালি নিয়ে রাসেলের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ব্রান্ড ভ্যালু তৈরি। যার মাধ্যমে তার ইচ্ছে ছিল নাম্বার ওয়ান কোম্পানি করা। তিনি বিভিন্ন দেশে ই-কমার্সের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যেখানে তিনি তার বর্তমান গ্রাহক ৪৪ লাখ হলেও ৭০ লাখ পর্যন্ত বলতেন। এটা বলে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন। যার ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানও ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল।
আরও গ্রাহককে নিয়ে আসা, শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল ইভ্যালির। সর্বশেষ পরিকল্পনার বিষয়ে রাসেল বলেছেন, কোনোভাবে সামাল দিতে না পারলে ইভ্যালিকে দেওলিয়া ঘোষণা করে দিতেন। তবে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল বলে জানাননি। রাসেল আস্তে আস্তে বিভিন্ন কোম্পানিকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারবেন বলে মনে করেন।
অর্থ পাচারের বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য দেননি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে, তারা যাচাই-বাচাই করছে। বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন রাসেল, তবে কোনো কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা শুরুর তথ্য পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি।
ইভ্যালিকে আরও সময় দেওয়া হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ হতে পারতো কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৪ সেপ্টেম্বর জানিয়েছে, যদি কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ করে তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিভিন্ন সংস্থা তদন্তে তাদের সময় দিয়েছিলো, কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যতো বেশি দীর্ঘায়িত হতো, ইভ্যালির দায় আরও বাড়তো এবং আরও মানুষ প্রতারিত হতেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১
পিএম/এমএমজেড