লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সয়াবিনের অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন দেশে সয়াবিন আমদানি বন্ধ থাকায় জেলার পাঁচটি সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় সয়াবিনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এতে পোল্ট্রি ফিড, ফিশ ফিড, ক্যাটেল ফিডসহ সয়াবিনের ওপর নির্ভরশীল সব পণ্যের দাম বাড়ছে।
লক্ষ্মীপুরের সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মালিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের ব্র্যান্ডিং নাম সয়াল্যান্ড। দেশের উৎপাদিত সয়াবিনের প্রায় ৭০ ভাগ চাষ হয় লক্ষ্মীপুরে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি অফিসের তথ্য কর্মকর্তা আবুল হোসেন জানান, গত মৌসুমে লক্ষ্মীপুর ৯০ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদিত হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্প নগরীর অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের এক নম্বর সয়াবিন উৎপাদনে জেলা লক্ষ্মীপুরে সাতটি সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মধ্যে বর্তমানে পাঁচটি সয়াবিন প্রসেসিং কারখানা চালু রয়েছে। যেগুলোতে দৈনিক প্রায় এক হাজার টন সয়াবিন প্রসেস (প্রক্রিয়া) করা হয়। যার মধ্যে বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত দু’টি কারখানায় ৪০০ টন, ভবানীগঞ্জের চরমনসাতে অবস্থিত একটি কারখানায় ১০০ টন এবং চর চামিতায় অবস্থিত দু’টি কারখানায় ৫০০ টন প্রসেস করা হয়। সবগুলো কারখানায় এক হাজার টনের পরিবর্তে বর্তমানে ৩০০ টন প্রক্রিয়াজাত হয়।
কারখানার মালিকদের সূত্রে জানা যায়, সয়াবিন মৌসুমে এসব কারখানা স্থানীয় বাজার থেকে প্রায় ৪০ হাজার টন সয়াবিন কিনে সংরক্ষণ করে প্রসেস করে। যা দিয়ে প্রায় তিন-চার মাস চলে। বাকি সময় আমদানি করা সয়াবিন দিয়ে তাদের কারখানা চালানো হয়। কিন্তু এ বছরে অনেকদিন সয়াবিন আমদানি বন্ধ রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর মনসা গ্রামের হাজী নূর নবী সয়াবিন প্রসেসিং মিলসটি গত ছয় বছর আগে গড়ে উঠেছে সয়াবিন ক্ষেতের মধ্যেই। এখানে কাঁচা সয়াবিন মেশিনের সাহায্যে সিদ্ধ করে শুকিয়ে ফুল ফ্যাট সয়াবিন তৈরি করা হয়। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে কারখানাটি সয়াবিন সংকটের মধ্যে পড়েছে।
কারখানার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মো. নোমান জানান, তাদের প্রসেসিং মিলে প্রতিদিন ১০০ মেট্রিক টন ফুল ফ্যাট সয়াবিন উৎপাদন হতো। করোনাকালে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবু দৈনিক ৮০-৯০ টন ফুল ফ্যাট সয়াবিন তৈরি হতো। কিন্তু গত দুই মাস ধরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত সয়াবিনের অভাবে কারখানা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. সুমন জানান, বছরের ছয় মাস স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সয়াবিন এবং বাকি ছয় মাস আমদানি করা সয়াবিন থেকে তাদের কারখানা চলে। কিন্তু করোনার কারণে চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে দেশব্যাপী চলমান লকডাউনের কারণে বিদেশ থেকে সয়াবিন আমদানি বন্ধ রয়েছে। গত দুই মাস আগে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সয়াবিনেরও সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় সয়াবিনের অভাবে তাদের কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত কোয়ালিটি সয়াবিন প্রসেসিং মিলসের মালিক মো. আবদুর রহিম জানান, তার কারখানায় দৈনিক ১১০ টন ফুল ফ্যাট সয়াবিন উৎপাদন হতো। গত দুই মাস উৎপাদন প্রায় বন্ধ। মাঝে মধ্যে মেশিন মেন্টেনেন্সের জন্য ১০-২০ টন সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সয়াবিন প্রায় শেষ। এখন যে সব ব্যবসায়ীর কাছে সয়াবিন আছে, তারা আরও লাভের আশায় স্থানীয় সয়াবিন বাজারে ছাড়ছেন না। অন্যদিকে এপ্রিল থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় সয়াবিনের অভাবে কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর চামিতার নাসরিন অ্যাগ্রো কমপ্লেক্সে জেলার বৃহত্তম দু’টি সয়াবিন প্রসেসিং কারখানা রয়েছে। এতে দৈনিক পাঁচ শতাধিক টন প্রসেসড বা ফুল ফ্যাট সয়াবিন উৎপাদিত হয়।
কারখানার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাসনাইন আবদুল্লাহ নাসির জানান, এ বছর প্রায় ৩০ হাজার টন স্থানীয় সয়াবিন কেনা হয়েছিল। স্থানীয় সয়াবিনে তাদের দুই মাস কারখানা চলে। এরপর তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন আমদানি করেন। বর্তমানে আমদানি করা সয়াবিনে তাদের কারখানা চলছে। তবে উৎপাদন ৫০০ টন থেকে কমে দৈনিক ২০০ টন হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, আমদানি করা হয়েছিল বলে কারখানা কোনো মতে চলছে, তবে স্থানীয় সয়াবিনে নির্ভর কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরীর চৌধুরী অটোর মালিক মো. রিয়াজ জানান, সয়াবিন প্রসেসিং মিলে কাঁচা সয়াবিনকে মেশিনের সাহায্যে সেদ্ধ করে শুকানো হয়। শুকানো সয়াবিনকে বলা হয় ফুল ফ্যাট সয়াবিন। ফুল ফ্যাট সয়াবিন বহু বছর সংরক্ষণ করা যায়। ফুল ফ্যাট সয়াবিন গুঁড়ো করে সয়াবিন মিল (খৈল) তৈরি করা হয়। সয়াবিন মিল থেকে তেল, পোল্ট্রি, মাছ, পশু খাদ্য এবং সয়াবিনজাত বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়।
সয়াবিন ট্রেডিং ব্যবসায়ী মো. ইসমাঈল জানান, কাঁচা সয়াবিন, ফুল ফ্যাট সয়াবিনসহ সয়াবিনের কাঁচামালের পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ঢাকার মতিঝিলের ট্রেডিং এজেন্সিগুলোর হাতে। ট্রেডিং এজেন্সিগুলো সয়াবিনের মৌসুমে স্থানীয় আড়তদারদের মাধ্যমে কাঁচা সয়াবিন কিনে সংরক্ষণ করে। কাঁচা সে সয়াবিন পাঠায় প্রসেসিং মিলে। প্রসেসিং মিলগুলো প্রতি টন ১৩০০-১৫০০ টাকার মধ্যে সেদ্ধ করে শুকিয়ে ফুল ফ্যাট সয়াবিন তৈরি করে আবার এজেন্সিতে পাঠায়। ট্রেডিং এজেন্সি থেকে ফিড কোম্পানিগুলো ফুল ফ্যাট সয়াবিন কিনে পোল্ট্রি ফিড, ফিশ ফিড, ক্যাটেল ফিড এবং সয়াবিনজাত পণ্য তৈরি করে। কোনো ট্রেডিং এজেন্সি বিদেশেও ফুল ফ্যাট সয়াবিন রপ্তানি করে।
গত মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে সয়াবিনের সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য ছিল প্রতি টন ৩৫ হাজার টাকা। বর্তমানে স্থানীয় সয়াবিনের দাম প্রতি টন ৫৫ হাজার এবং আমদানি করা সয়াবিনের দাম ৫৯ হাজার টাকা।
মিল মালিক সুমন জানান, আমদানি করা সয়াবিনের অভাবে চার মাসের ব্যবধানে প্রতি টন কাঁচা সয়াবিনের দাম প্রায় ২০ হাজার টাকা বেড়েছে। এর পুরো প্রভাব পড়েছে সয়াবিনজাত পণ্যে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২১
এসআই