ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

কস্টিক সোডা আমদানির আড়ালে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২
কস্টিক সোডা আমদানির আড়ালে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি সংগৃহীত ছবি।

ঢাকা: সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে কস্টিক সোডা উৎপাদনের নামে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র লবণ আমদানি করছে। কস্টিক সোডা হিসেবে আমদানি পণ্য দেখিয়ে ওই লবণ দেশের বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

এক টন কস্টিক সোডা উৎপাদনে যে পরিমাণ লবণ প্রয়োজন, আমদানি করা হচ্ছে তার দ্বিগুণ। এখন ভোজ্য লবণ আমদানি নিষিদ্ধ থাকার কারণে কস্টিক সোডা বা কস্টিক সোডা উৎপাদনের নামে আনা হচ্ছে লবণ।

এতে একদিকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে মার খাচ্ছে দেশীয় লবণশিল্প। এখন লবণ আমদানি নিষিদ্ধ রয়েছে। কেননা লবণ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ একটি অসাধু চক্র কস্টিক সোডা আমদানির সুযোগ নিয়ে এর আড়ালে প্রতি বছর টনকে টন লবণ আমদানি করছে।

বিশেষজ্ঞ ও কস্টিক সোডা এবং লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, কস্টিক সোডার সঙ্গে অ্যাসিড মেশালে লবণ তৈরি হয়। কস্টিক সোডার চেয়ে বাজারে লবণের চাহিদা বেশি। অনেক ক্ষেত্রে দামও বেশি। আবার লবণ আমদানিতে কস্টিক সোডার আমদানির তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি। ফলে কস্টিক সোডার এইচএস কোড ব্যবহার করে অনেকেই লবণ আমদানি করছেন। এরপর ওই লবণ দেশের বাজারে বিক্রি করছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, কস্টিক সোডার ওপর আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ ও কাস্টমস ডিউটি ৫ শতাংশ বলবৎ রয়েছে। আর ১ কেজি ভোজ্যলবণ আমদানিতে শুল্ক ও কর দিতে হয় ৯৩ শতাংশ এবং শিল্প লবণ আমদানিতে শুল্ক ও কর দিতে হয় ২৫ শতাংশ।

এদিকে এনবিআরের তথ্যমতে, কস্টিক সোডা আমদানিকারক হিসেবে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো- এমএইসি গ্রুপবিডি, সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড, কেইএনপার্ক বাংলাদেশ, এসএমডিএস বাংলাদেশ, এসটিএল বাংলাদেশ, টিসিসিএল বাংলাদেশ ইত্যাদি। দেশে প্রতিবছর চার লাখ টন কস্টিক সোডার চাহিদার বিপরীতে সাড়ে তিন লাখ টন কস্টিড সোডা উৎপাদনের তথ্য রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে। অথচ আমদানিও হয় প্রায় চার লাখ টন।

এদিকে দেশে প্রতিবছর লবণের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ টন, যার প্রায় পুরোটা বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দুই থেকে আড়াই লাখ টন লবণের ঘাটতি রয়েছে। অথচ ব্যবসায়ী ও লবণ মিল মালিকদের হিসাবে, দেশে লবণের ঘাটতি রয়েছে ১০ লাখ টন। তথ্যের এমন গরমিলের ফাঁকে কস্টিক সোডার আড়ালে লবণ আমদানি করছে একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র।

জানা গেছে, এখন দেশে ভোজ্যলবণ আমদানি নিষিদ্ধ। এখন লবণ আমদানিতে ৯৩ শতাংশ শুল্ক ও কর দিতে হয়। ২০২০ সালে উৎপাদন ঘাটতি হওয়ায় লবণের সাময়িক সংকট দেখা দেয়। সেসময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানির সুযোগ দিয়েছিল। তবে, অনেক ছোট ও বন্ধ মিল লবণ আমদানি করে তা বড় মিলের কাছে বিক্রি করেছিল। এতে বাজারে লবণের দাম কমেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।

চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দেশে খাওয়ার লবণের (সোডিয়াম ক্লোরাইড এইচএম কোড ২৫০১.০০.১০) আমদানি নিষিদ্ধ থাকলেও শিল্প লবণ (সোডিয়াম সালফেট/ডাইসোডিয়াম সালফেট) আমদানির সুযোগ রয়েছে। খাওয়ার লবণের সঙ্গে শিল্প লবণের দামে তারতম্য অনেক বেশি হওয়ায় অপঘোষণার মাধ্যমে খাওয়ার লবণ আমদানির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এছাড়া খাওয়ার লবণের সঙ্গে শিল্প লবণ মিশিয়ে বাজারজাত করার অভিযোগও রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের লবণচাষি ও লবণ মিলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণচাষিদের প্রতিরক্ষণ, আমদানি করা শিল্প লবণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প লবণ (সোডিয়াম সালফেট/ডাইসোডিয়াম সালফেট) আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করছি। ’ 

৩ জুন প্রস্তাবিত বাজেটের এ প্রস্তাব ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করে বাজেট পাস করা হয়েছে, যা এখন বলবৎ রয়েছে। এরপরও একটি অসাধু চক্র কস্টিক সোডার আড়ালে লবণ আমদানি করে বাজারে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, কস্টিড সোডার বিভিন্নভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকখাত, কাগজশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, স্বর্ণ পরিশোধন ও জীবাণুনাশক হিসেবে এ রাসায়নিক ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে এক সময় প্রয়োজনের পুরোটাই আমদানি করা হতো। এখন বছরে প্রায় চার লাখ টনের মতো উৎপাদন হয়। আর ডজনখানেক কোম্পানি কস্টিক সোডা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।

বিক্রয় পর্যায়ে কস্টিড সোডার ওপর ভ্যাট রয়েছে ১৫ শতাংশ। এআইটি ও কাস্টমস ডিউটি রয়েছে ৫ শতাংশ। এছাড়া কারখানা পর্যায়ে আরও ৫ শতাংশ ডিউটি রয়েছে। উৎপাদন, আমদানি, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ পর্যায়ে মোট ভ্যাট ও ট্যাক্স রয়েছে ২৫ শতাংশ, যা লবণের তুলনায় কম। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কস্টিক সোডার আড়ালে লবণ আমদানি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অন্তত সাত ধরনের কস্টিক সোডা রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহার হয়। কস্টিক সোডা, ব্লিচিং ফাইন ও ব্লিচিং পাউডারসহ সাত ধরনের রাসায়নিকদ্রব্য উৎপাদন হচ্ছে দেশে। আর প্রতিবছর আমদানিও হয়। যেসব এইচএস কোডের বিপরীতে কস্টিক সোডা আমদানি হয় সেগুলো-২৮১৫১১০০, ২৮১৫১২০০।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইমপোর্টার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাজাকাত হারুন মানিক বলেন, ‘দেশে কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। যারা কস্টিক সোডা উৎপাদন করছে। যদি কেউ কস্টিক সোডার আড়ালে লবণ আমদানি করে তাহলে অবশ্যই সেটি অপরাধ ও অন্যায়। এখানে সরকারের উচিত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। ’

এদিকে দেশে উৎপাদিত লবণ চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকার পরও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিদেশি লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র রুখতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে কক্সবাজার লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদ।  

৯ অক্টোবর তারা কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। এতে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শহিদ উল্লাহ বলেন, ‘চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাহিদার চেয়েও বেশি লবণ মজুদ রয়েছে। সেখানে একটি সিন্ডিকেট আবারও সরকারকে ভুুল তথ্য দিয়ে বিদেশি লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে। এ মুহূর্তে দেশীয় লবণশিল্পবিরোধী ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।