ঢাকা, শনিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

আমেই কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে ‘আমজনতা’

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২২
আমেই কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে ‘আমজনতা’

রাজশাহী: আম, আম আর আম। যেদিকেই তাকাবেন সেদিকেই কেবল আম।

এ যেন আমের এক সুবিশাল স্বর্গরাজ্য। যেখানে দিনভর চলে সাধ আর সাধ্যের দর কষাকষি। আর হবেই বা না কেন? রাজশাহীর আম বলে কথা। নামেই যার খ্যাতি। ভুবন ভোলানো স্বাদ ও জাতের আমের সমাহার ঘটে এখানে। ভরা মৌসুমে চারিদিকে যেন আমের বন্যা বয়ে যায়। দর্শন, গুণ ও সুমিষ্ট আমের স্বাদেই পরিচয় মেলে রাজশাহীর। তাই বছর ঘুরে সেই চির চেনা রূপে ফিরেছে আমের রাজধানী। ‘আমময়’ হয়ে উঠেছে পদ্মাপাড়ের এ ছোট্ট পরিপাটি শহর। আমেই কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে আমজনতা।  

রাজশাহীর শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই এখন একই দৃশ্যপট। হাটে-মাঠে, পথে-প্রান্তরে, বাগানে বাগানে, পাড়ার অলি-গলিতে এখন শুধুই আমের হাঁক-ডাক। শহরের বিভিন্ন প্রধান সড়ক ও মোহনাগুলো এখন কাঁচা-পাকা আমে ভরে গেছে। আনাচে-কানাচে থেকে বড় বড় ঝুড়ি ও বিভিন্ন আকৃতির প্লাস্টিকের ক্যারেটে করে আম আসছে। মধু মাস জ্যৈষ্ঠ শেষ হতে চলেছে বাংলার প্রকৃতিতে। তাই শহর ও গ্রামের নতুন-পুরনো বাগানের গাছ থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পুরোদমে আম ভাঙা হচ্ছে।

যে কারণে রাজশাহীর বাতাসে এখন যেন কেবলই মিষ্টি আমের সৌরভ ম ম করছে। নানা কারণে এ বছর কমেছে আমের ফলন, বেড়েছে দাম। গেল ৩/৪ বছরের তুলনায় এবার আমের দাম প্রায় তিনগুণ বেশি। এরপরও বাগানের গাছ থেকে আম ভাঙার পরপরই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ঝুড়ি ঝুড়ি আম। তাই কম ফলনেও হাসি ফুটেছে রাজশাহীর আমচাষিদের মুখে। করোনা দু’বছরের লোকসানের পর ভালো দাম পাওয়ায় চাষি ও কৃষকরা খুশি। তবে এ বাড়তি দাম নিয়ে ক্রেতারা পড়েছেন চরম অস্বস্তিতে। নিজের, পরিবারের, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য বিভিন্ন প্রান্তে আম পাঠাচ্ছেন বাড়তি দামেই।  

অপরিপক্ব আমে কেমিক্যালের মিশ্রণ নয়, বেঁধে দেওয়া সময়ের পরেই এবার পরিপক্ব আম ভাঙা হচ্ছে গাছ থেকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে হাট-বাজার থেকে বিদায় নিতে শুরু করেছে জাত আম গোপালভোগ ও মোহনভোগ। তাদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে ক্ষিরসাপাত (হিমসাগর), ল্যাংড়া, লক্ষ্মণভোগ, আম্রপালিসহ নানা জাত ও বাহারি নাম আর স্বাদের আম। বিরামহীন বেচাকেনা চলছে প্রাচীন এ জনপদে। রাজশাহীজুড়ে এখন কেবল আমেরই রাজত্ব। ধারণা করা হচ্ছে, ফলন কম হওয়ায় এবার সময়ের আগেই ফুরিয়ে যাবে রাজশাহীর আম। যার ফলে মাঝ মৌসুমেই চাঙা হয়ে উঠেছে আমের ব্যবসা।

কেবল শহরের বাজারে নয়, আমকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য পাল্টে দিয়েছে এ অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতিও। রাজশাহী অঞ্চলের দুটি বড় আমের মোকাম- রাজশাহীর বানেশ্বর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট। প্রতিদিন এখানে বেচাকেনা হচ্ছে প্রায় ৩/৪ কোটি টাকার আম। আমের কারবার নিয়ে এ অঞ্চলের ৫০ হাজার মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থানও হয়েছে। বাগানের গাছ থেকে আম নামানোর কামলা থেকে আম চালানের ঝুড়ি বানানো এবং বাজারগুলোয় নানা সহায়ক কাজে নিয়োজিত লোকজনের কর্মসংস্থানে উত্তরের এ ছোট্ট জনপদ বছর ঘুরে আবারও কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে।  

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের মোকাম পুঠিয়ার বানেশ্বর। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, গোপালভোগ আম প্রায় নেই। ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগরই বেশি। আর চলতি সপ্তাহে উঠেছে ল্যাংড়া জাতের আম। রয়েছে লক্ষ্মণভোগও। চাষিরা গাছ থেকে আম নামিয়ে ঝুড়ি বা প্লাস্টিকের ক্যারেটে করে এ আম হাটে আনছেন। দর-দামের পর ঝুড়িসহ তা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা। রোদ-বৃষ্টি ছাপিয়েই দিন-রাত সমানতালে চলছে আমের কারবার। এবার ফলন কম হলেও দাম বেশি পাওয়ায় আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বেশ খুশি।

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের মোকাম পুঠিয়ার বানেশ্বরে গিয়ে দেখা যায়, আমের বেচাকেনায় এখন পুরোদমে জমজমাট হয়ে উঠেছে এ হাট। সকাল থেকেই এখানে আসছে নানা জাতের আম। হাটের চারপাশে যেন তৈরি হয়েছে আমের মোহনা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব আমের মিষ্টি ঘ্রাণ খুব সহজেই বিমোহিত করছে সাধারণ ক্রেতাদের। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁক-ডাকে দিনভর সরগরম থাকছে রাজশাহী জেলার সর্ববৃহৎ এ আমের হাটের পথ-প্রান্তর।  

গোপালভোগ আম শেষের দিকে। বর্তমানে ক্ষিরসাপাত (হিমসাগর), লক্ষ্মণভোগ ও ল্যাংড়ার দখলে রয়েছে আমের বাজার। জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময় মেনে আগামী ১৫ জুন বাজারে আসবে আমের রাজা ফজলি ও আম্রপালি। সর্ববৃহৎ এ হাটে এখন ক্ষিরসাপাত ও গোপালভোগ আম পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণ দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায়। ল্যাংড়া আম দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায়। এছাড়া জাত ভেদে আঁটি জাতের আম বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। আর লক্ষ্মণণভোগ আম প্রতিমণ এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া কালুয়া ও দুধস্বরসহ বেশ কয়েকটি বনেদি জাতের আম দুই হাজার ৬০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে এ বানেশ্বর হাটে।

পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটের ইজারদার ওসমান আলী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ফলন কম হওয়ায় এ বছর আমের দাম তুলনামূলক বেশি। তবে বেশি দামে ক্রেতারা অসন্তুষ্ট হলেও ব্যবসায়ীরা খুশি। এটি রাজশাহীর জেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ আমের মোকাম। পুঠিয়া ছাড়াও জেলার দুর্গাপুর, বাগমারা, বাঘা, চারঘাটের বাগান মালিক, চাষি ও ব্যবসায়ীরা এখানে আম বিক্রি করতে আসেন।  

আর সীমানার কাছাকাছি এবং বেচাকেনা বেশি হওয়ায় পাশের জেলার নাটোরের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও মানুষজন এ হাটে রোজ আম বিক্রি করতে আসেন। এছাড়া রাজশাহীর আম পাইকারি দরে কেনার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম, খুলনা সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও আসেন। এজন্য উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। বাজার কমিটিও আম পরিবহন ও কেনাবেচা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে চাষি ও ব্যবসায়ীদের।  

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, গেল বছর ১৮ হাজার হেক্টর বাগান থেকে ২ লাখ ১৭ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এবার রাজশাহীতে ১৮ হাজার হেক্টর জমির বাগান থেকে ২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সময় মেনে আম্রপালি ও ফজলি আম নামবে ১৫ জুন, আশ্বিনা ও বারী আম-৪ ১০ জুলাই, গৌড়মতি ১৫ জুলাই এবং সবশেষে নতুন জাতের ইলামতি ২০ আগস্ট থেকে ভাঙা শুরু হবে। আর নানা কারণে গাছে ফলন কম হলেও সমস্যা হবে না। আগামী মাসটা ঝড়-ঝঞ্ঝা ও শিলাবৃষ্টির কবলে না পড়লে এ আম দিয়েই গোটা দেশের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০২ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২২
এসএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।