ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

কোরবানির পশুর হাটে মধ্যবিত্তের হিসাব মিলবে তো?

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০২২
কোরবানির পশুর হাটে মধ্যবিত্তের হিসাব মিলবে তো?

ফেনী: ‘মধ্যবিত্তের আকাশটা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে খুব ছোট, বাম কান থেকে ডান কানের দূরত্ব মেপে এক জীবন’। কবি খালেদ রাহীর কবিতার লাইন দুইটি মধ্যবিত্তের জীবনের পরিধি মেপে দিচ্ছে।

নানা সংকট মোকাবিলা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার গল্প বলে দিচ্ছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের এই অকালে এই শ্রেণীর জীবন যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে।

এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তির দিকে তার ওপর বাজেটের খড়ক। কোনো নিত্যপণ্যের দাম কমাতো সম্ভাবনা নেইই বরং বেড়েই চলেছে, কমার ইঙ্গিতও নেই। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি আয়। সংসারের টানাপড়েনের হিসাব কষতে কষতেই সামনে আসছে ঈদুল আজহা।  

এই ঈদকে ঘিরে বড় ধরনের খরচের অনুষঙ্গ থাকায় মধ্যবিত্তের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। এই দুর্দিনে কোরবানি জন্য পশু কিনে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হবে তো? এমনটাই ভাবছেন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার।  

দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ:

ফেনী শহরের বড় বাজার ও পৌর হকার্স মার্কেটের মাংস বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেল বছর এই সময়ে গরুর মাংসের কেজি ছিল সাড়ে ৬শ থেকে ৭শ টাকা। এই বছরের এই সময়ে গরুর মাংসের কেজি সাড়ে ৭শ থেকে ৮শ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে ২শ টাকা করে বাড়লো।  

এ হিসাবে গেল বছর ৫০ কেজি ওজনের যে গরুটা ৩২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে এবার সেটিতে ১০ হাজার টাকা বেড়ে ৪২ হাজার টাকা হবে। ১শ কেজি ওজনের যে গরুটা ৬৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে তা এবার ২০ হাজার টাকা বেড়ে বিক্রি হবে ৮৫ হাজার টাকা।  

হিসাব মতে, মাংসের দামের ভিত্তিতে দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ।  

এ হিসাবে মাংসের দামের ওপর ভিত্তি করে। গরুর ব্যবসায়ী ও খামারিরা বলছেন দাম আরও বাড়তে পারে। বিপত্তি এখানেই মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের আয় তো এতটা বাড়েনি। তাহলে তারা এত ব্যয় সংকুলান করবে কীভাবে।  

সাহস করতে পারছেন না অনেক মধ্যবিত্ত:

কয়েকটি মধ্যবিত্ত পরবিারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতবার তারা কোরবানি দিলেও এবার আর তারা সাহস করতে পারছেন না।  

ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ সতর এলাকার কলিম উল্লাহ নামের একজন জানান, গেল বছর বাড়ির পাশে সাতজন মিলে একটা পশু কোরবানি দিয়েছিলেন তিনি। তখন প্রতি ভাগে খরচ হয়েছিল ১৫ হাজার টাকা। এবার সেখানে খরচ ৭ থেকে আট হাজার বেড়ে ২২/২৩ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আয়তো বাড়েনি।

দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে ঋণে জর্জরিত ওই ব্যক্তি জানান, এই বার আর কোরবানি দিতে সাহস পাচ্ছি না।

ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুরের কবির আহম্মদ নামের একজন জানান, অনেক কষ্টে কিছু দিন আগে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি। এখন এই কোরবানিতে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কোরবানির পশু পাঠাতে হবে। নিজেও কোরবানি দিতে হবে। তা নাহলে মেয়েকে চোখ দেখাতে পারবে না। শুনছি গেল বছরের থেকে এই বছর গরুর দাম অনেক বেশি থাকবে। কেমনে কী করব এই চিন্তায় ঘুম আসে না।

ছাগলনাইয়া কলেজ রোড় এলাকার আবু সৈয়দ নামের একজন জানান, প্রতি বছর তিনি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে একটা গরু নিয়ে কোরবানি দিয়ে থাকেন এবার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে বাজারে কোন গরু চোখে পড়েনি তার। যারাই দাম করেছেন ৭০ হাজারের ওপরে।  কোরবানি দেওয়া নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তিনি।  

বাজার গরম, ক্রেতার পকেট ঠাণ্ডা:

চলতি সপ্তাহে জেলার ছাগলনাইয়া, সোনাগাজীর বক্তারমুন্সী, ফুলগাজী পাইলট হাইস্কুল, পরশুরাম পাইলট মাঠ ও ছাগলনাইয়ার চাঁদগাজী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, বাজারে গরু-ছাগল-মহিষ উঠতে শুরু করেছে। তবে বিক্রি তেমনটা হচ্ছে না।  

সর্বশেষ রোববার (৩ জুলাই) ছাগলনাইয়া পাইলট হাইস্কুল মাঠে পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায় সারা দিনে সাকুল্যে ১০টি গরুও বিক্রি হয়নি।  

বাজার ঘুরে কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বাজারে এসেছেন বাজার যাচাই করতে কিনতে নয়। পশুর দামের বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন জানান, গেল বছরের  চাইতে এ বছর পশুর দাম বেশি। গতবারের বাজেটে এবার কোরবানি দেওয়া সম্ভব নয়।  

সাইদুর রহমান নামের একজন জানান, গতবার তিনি ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে যে গরুটি কিনেছেন এবার তার দাম চাওয়া হচ্ছে ৮০ হাজার টাকা।  

খামারিদের মুখ ভার: 

সোনাগাজীর বক্তারমুন্সী ও ছাগলনাইয়া পাইলট হাইস্কুল মাঠের পশুর হাটে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন খামারির সঙ্গে। যারা সারা বছর পশু মোটা তাজা করে হাটে নিয়ে এসেছেন বিক্রি করতে। হাটে পশু তোলার পর মানুষের দাম করা দেখে হতাশ তারা।

আশরাফুল ইসলাম নামের ছাগলনাইয়ার এক তরুণ খামারি বলেন, জিনিসপত্রের যে হারে দাম বেড়েছে। এই কারণে গরুর দামও বলছেন না ক্রেতারা। প্রতিটি গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে। পশু লালন-পালন ব্যয় প্রায় অর্ধেকের মতো বেড়েছে। বাজারে আশা ক্রেতারা তো দাম সেভাবে বলছেন না।

আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, দানাদার খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় তারা বেশি পশু লালন-পালন করতে পারেননি। গবাদিপশুর খাদ্যের জোগান দিতে না পেরে অনেক খামারিই বছরের মাঝামাঝি সময়ে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

তারা আরও বলেন, গতবছর লাইভ ওয়েটে (ওজনে) পশু বিক্রি করেছেন। তবে এ বছর খরচ বেড়ে যাওয়ায় সে সুযোগ থাকছে না। এ বছর ভালো দাম না পেলে লোকসানে খামার বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

এখনও বাজারে নেই উত্তরের গরু: 

প্রতি বছর ফেনীর পশুর হাটবাজারগুলোতে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলার প্রচুর গরু দেখা গেলেও এবছর তেমনটা দেখা যাচ্ছে না।  

স্থানীয় পশু বেপারী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে অনেক পশু মারা গেছে। অনেক স্থানে বন্যা পরিস্থিতি এখনও অবনতি হয়নি। রাস্তা-ঘাট ঠিক না হওয়ায় এখনও পশু আনা যাচ্ছে না। এদিকে বাইরের জেলা গরু না আসাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন জেলার গরু খামারিরা। কারণ বাইরের জেলা ও ভারতের গরু না এলে ভালো দাম পাবেন তারা। অপরদিকে এটাকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন ক্রেতারা।

শাহ আলম নামের বক্তারমুন্সী বাজারের এক ক্রেতা বলেন, বাইরের জেলা থেকে গরু না এলে স্থানীয় খামারিরা দাম হাঁকাবেন বেশি ক্রেতারা অসহায় হয়ে তা কিনতে হবে।  

শেষের দিকে দাম কমার আশা: 

ঈদুল আজহার পশুর হাট সবে জমতে শুরু করেছে। বাজারগুলোতে প্রথম হাটে ক্রেতারা দাম যাচাই করে এসেছেন। এখনও কেউ কোরবানির জন্য পশু কিনেননি। ক্রেতারা বলছেন বাজারে পশুর দাম এখন অনেক বেশি মনে হচ্ছে তবে ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে পশুর দাম তত কমতে থাকবে। বাজারে পশুর সরবরাহ বাড়লে দাম কিছু সহনীয় হবে। আর তখনই মধ্যবিত্তরা বাজারে গিয়ে পশু কিনবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৯ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০২২
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।