ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

অর্থনৈতিক অঞ্চলে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস বেজা চেয়ারম্যানের

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২২
অর্থনৈতিক অঞ্চলে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস বেজা চেয়ারম্যানের মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন | ছবি: ডিএইচ বাদল

ঢাকা: দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ব্যবসায়ীদের যেকোনো সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা)  নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোনের গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।

পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস যথাসময়ে দিতে পারছি না সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা এগোচ্ছি। এ পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগকারী আমাদের কাছে এসে বলেননি—আমরা পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না বা দিচ্ছেন না। আমরা যথাসময়ে যার যেটুকু প্রয়োজন সরবরাহ করছি।

রোববার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-ইআরএফ সেমিনার হলে ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫০টি শিল্প ও অবকাঠামোর উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর’ উপলক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন শেখ ইউসুফ হারুন।

ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভীর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চলনায় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিতি ছিলেন বেজার মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও অর্থ) ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান আরিফ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক প্রমুখ।

ইকোনমিক জোনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি নিশ্চিত করা না গেলে উৎপাদন বিঘ্নিত হবে। এখন পর্যন্ত মিরেরসরাইয়ে চাহিদানুযায়ী বিদ্যুৎ সাপ্লাই নিশ্চিত করা যায়নি। সেখানে ২৩০ কেভি ভোল্টেজ প্রয়োজন, যা দেওয়ার সক্ষমতা পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নেই। এটা নিশ্চিত করা না গেলে কীভাবে সময়মতো উৎপাদন সম্ভব? এমন এক প্রশ্নের জবাবে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে সাময়িক একটু সমস্যা হচ্ছে। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার জন্য আমাদের বিদ্যাৎ উৎপাদন সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়েছে। আমাদের যেসকল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস ওয়েল বা ডিজেলের জন্য আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এই অসুবিধাটি অচিরেই শেষ হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ না হলেও ব্রুনাইয়ের সাথে আমাদের এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখান থেকে আমরা কিছু তেল পাবো। সরকার সব দিক থেকে চেষ্টা করছে সমস্যা সমাধানের জন্য।

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইকোনমিক জোনের যে কয়টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে গেছে তারা গ্যাস পাচ্ছে। আমরা ইকোনমিক জোনের দোরগোড়ায় ডিআরএস স্থাপন করেছি। সেখান থেকে জোনের যে কেউ গ্যাস নিতে পারে। তবে গ্যাসের বিকল্প এলএনজির দাম বিশ্ববাজারে বৃদ্ধির কারণে আমরা সেটি পাচ্ছি না। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে আমরা প্রতিশ্রুতি পেয়েছি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ শিল্প কারখানায় পাবো। তাই বলতে পারি গ্যাস ও বিদ্যুতের কোনো সমস্যা হবে না।

বেজা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্থ করেছিল, উৎপাদনে যাওয়ার আগে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি পুরোদমে দেওয়া হবে। কিন্তু সময়মতো তা না পেয়ে একটি গ্রুপ নিজের খরচে ডিআরএস লাইন নির্মাণ করেছে। এখন পর্যন্ত বেজার পক্ষ থেকে কোনো পাইপলাইন সেট করা হয়নি। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীরা অনেকেই বাধ্য হয়ে নিজের খরচে তা করছেন। এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইউসুফ হারুন বলেন, আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোনের আসেন, আমরা কোথায় ডিআরএস স্থাপন করেছি, কোথায় বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন করেছি সেটা দেখতে পারবেন। ডিআরএস এর জন্য ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছি।

তিনি বলেন, আমাদের এমন কোনো বিনিয়োগকারী বলেননি যে, আমরা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি পাচ্ছি না। তারপরও আপনাদের কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে, তাদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। আমরা তাদের বক্তব্য শুনবো এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবো।

ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগকারীরা যে বড় অংকের ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন, উৎপাদনে যেতে না পারলে ঋণ শোধ করা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে তাদের। এ ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নিতে বেজা সহায়তা করতে পারে কিনা জানতে চাইলে নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের তো এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়াই রয়েছে। আমরা দেশি বিনিয়োগকারীদের চাহিদা মেটাতে পারছি না, সেটা ঠিক নয়। প্রতিদিন আমাদের কাছে বিনিয়োগকারীরা আসেন তাদের সহযোগিতা করি। বিনিয়োগে উৎসাহী করছি, অনেকেই বিনিয়োগ করেছেন। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস যথাসময়ে দিতে পারছি না, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা এগোচ্ছি। এ পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগকারী আমাদের কাছে এসে বলেননি—আমরা পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না বা দিচ্ছেন না। আমরা যথাসময়ে যার যেটুকু প্রয়োজন সরবরাহ করছি।

আগে ব্যবসায়ীদের নিয়ে ‘বেজা’ বৈঠক করতো। আপনি চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাদের সাথে বসেছেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, আমি যোগ দেওয়ার পরে বিনিয়োগকারীদের সংগঠনের সাথে একাধিকবার বসেছি, তাদের মতামত নিয়েছি। ব্যবসায়ীদের সাথে আমরা কয়েকবার কথা বলেছি। তবে উদ্বোধনের আগে বসার কোনো সুযোগ নেই।

এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় সবগুলো ইকোনমিক জোনে পানির সাপ্লাই যথাযথ করা হবে। এখন পর্যন্ত কি বিশ্বব্যাংকের কোনো সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন? কতটুকু পানি এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে? এছাড়া পানির সংস্থান না পেয়ে উদ্যোক্তারা নিজ উদ্যোগে ডিপ টিউবওয়েল বসিয়েছেন। সেখানে আবার মিটার বসিয়ে ওয়াসা রেটে বিল নেওয়া হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, আমাদের ইকোনমিক জোনগুলোতে পানি নিয়ে আমরা ফিজিবিলিটি পরীক্ষা করিয়েছি। সে লক্ষ্যে আমরা ১০০টি টিউবঅয়েল বসাবো। আমরা প্রতিটি থেকে ১০০ এমএলডি করে পানি পাবো বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা পাচ্ছি পয়েন্ট শূন্য পাঁচ এমএলডি পানি। এ পর্যন্ত ২০টি আমরা স্থাপন করতে পেরেছি। এছাড়া আপনারা জানেন যে, ফেনীতে যে সেচ প্রকল্প রয়েছে, সেখান থেকে অতিরিক্ত যে পানি আসবে সেটা আমরা নিয়ে আসবো। এখান থেকে পাবো ১০০ এমএলডি। আর বিশ্বব্যাংকের যে প্রকল্প রয়েছে, সেখান থেকে পাবো ৩০ এমএলডি। মোট ১৩০ এমএলডি পানি আমরা পাবো। বর্তমানে যে ১৬/১৭টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারবে তাদের যে চাহিদা রয়েছে, সেটা ২০২৮ সালের মধ্যে পূরণ করতে পারবো। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক মেঘনায় একটি পানির গ্রিড লাইন স্থাপন করবে। আশা করছি, ২০৩০ সালের মধ্যে এখন থেকে এক হাজার এমএলডি পানি পাবো। তবে আমি বলতে চাই শিল্প নির্মাণের জন্য মাটির নিচ থেকে যে পানি তোলা হচ্ছে। কিন্তু কারখানা চালুর পরে আর মাটির নিচের পানি ব্যবহার করতে হবে না। মাটির নিচের পানি আমরা অপচয় করতে দেবো না।

ইকনোমিক জোনগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না, এর কারণ কী জানতে চাইলে শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছি কম, সেটার কোনো বিতর্ক নেই। তবে আমাদের ইকোনমিক জোনে যতগুলি কোম্পানিকে জায়গা দিয়েছি, তার ৮০ শতাংশ জয়েন্ট ভেঞ্চারে আমাদের দেশে এসেছে। এছাড়া আমাদের জিটুজি যে জোনগুলি হচ্ছে সেগুলো পুরোটাই বিদেশি বিনিয়োগে হচ্ছে। জাপান, ভারত ও চায়না আমাদের সাথে চুক্তি করেছে। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে দুর্নীতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে যে মাত্রায় দুর্নীতি হতো এখন সেই মাত্রা পরিবর্তন হয়েছে। আসরা চেষ্টা করছি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে দুর্নীতি কমে যায়। জিটুজি ভিত্তিতে যে জোনগুলো হবে সেখানে চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে দুর্নীতিমুক্ত। দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে শুধু বেজার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সরকারি বেসরকারি সবাই মিলে কাজ করলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা সম্ভব। বেজার পক্ষে পুরোটা দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবো বেজা অফিস দুর্নীতিমুক্ত। আমরা চাই আমাদের সহযোগী সংস্থাগুলো যদি দুর্নীতিমুক্ত হয় তাহলে সুষ্ঠু একটি পরিবেশ দাঁড়াবে। আমরা ১২৫টি সার্ভিস দেই, এর মধ্যে ৪৮টি সেবা আমরা অনলাইনে দিয়ে থাকি।

মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের উন্নয়ন কাজ স্থবির হয়ে পড়লেও বেজা চেষ্টা করেছে কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার। এরই ধারাবাহিকতায় বেজা আগামী ২৬ অক্টোবর ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৫০টি শিল্প ও অবকাঠামো উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থান-২০২২’ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যাচ্ছে।

এ পর্যন্ত সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। যার মধ্যে ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে উন্নয়ন কাজ চলমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে এ পর্যন্ত ২২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এছাড়া ১২টি লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক শিল্পোৎপাদন শুরু করেছে এবং আরও ৬১টি শিল্প নির্মাণাধীন। এই অঞ্চলগুলোতে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে জাপান, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, নরওয়েসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২২
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।