চাটমোহর (পাবনা): পাবনার চাটমোহরের ইমামুল হোসেন ও শফিকুল ইসলাম পেশায় দিনমজুর। রাজমিস্ত্রির জোগানদার, কৃষি জমিতে কাজ, হাট-বাজারে কাঁচা তরকারি বিক্রি সবই করতে হয় তাদের।
নিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে চরে তাদের জীবন। তারপরও দমে যায়নি তারা। দিনমজুরি করেও পড়ালেখা করেছে এ দুজন। কৃতিত্বের স্বাক্ষরও রেখেছে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা। কিন্তু ভালো ফল করেও টাকার অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের শিক্ষাজীবন।
চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের ধুলাউড়ী গ্রামের দরিদ্র তরকারি বিক্রেতা মঞ্জিল প্রাং ও সালেহা খাতুনের ছোট ছেলে ইমামুল হোসেন জিপিএ-৫ পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে এলাকার সবাইকে। সে বোয়ালমারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
তার বড় ভাই আকরাম হোসেন ও বোন শাপলা খাতুন পাবনা অ্যাডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ (অনার্স) শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী। তারা বাড়ি বাড়ি প্রাইভেট পড়িয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। তিন ভাইবোনকে পড়ানোর সামর্থ্য নেই তাদের দরিদ্র বাবার।
ইমামুল ও তার বাবা মঞ্জিল প্রাং বাংলানিউজকে জানান, সম্বল তার তিনি ছেলে মেয়ে আর ১০ শতকের উপর বসতবাড়িটি। হাট-বাজারে কাঁচা শাক-সবজি বিক্রি এবং অন্যের জমি বর্গাচাষ করে কোনোমতে সংসার চালান তিনি। সংসারে খরচ যোগানোর পর ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করানোর সামর্থ্য তার নেই।
তাই ছোট ছেলে ইমামুল সবজি বিক্রি এবং দিনমজুরি করে পড়াশুনা করছে। ভালো ফল করার পরও শুধু টাকার অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার শিক্ষাজীবন। এ নিয়ে পরিবারটি শংকিত। অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে ইমামুল।
ইমামুল দিনে পড়ার সুযোগ পায়নি। তখন তাকে কাজে যেতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। তাকে পড়তে হয়েছে রাতে। দরিদ্র ও মেধাবী হওয়ায় স্কুল থেকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল সে। পরীক্ষার ফরম পূরণের কিছু টাকা বাবার কাছে থেকে পেলেও বাকি টাকা দিনমজুরি করেই জোগাড় করতে হয়েছিল।
ইমামুল জানায়, পিতা-মাতা, স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় সে ভাল ফলাফল করেছে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি নিয়ে শঙ্কিত ইমামুলের শিক্ষাজীবন শুধু টাকার অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ।
বোয়ালমারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, দরিদ্র ও ভালো ফলাফলের কারণে আমরা ইমামুলকে বিনা বেতনে পড়িয়েছি। আর্থিক সহযোগিতা পেলে শরীফ ভবিষ্যতে ভালো করবে।
অপর দিকে দিনের বেলা রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ আর রাতে লেখাপড়া করতো শফিকুল ইসলাম সবুজ।
কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস সাধনা করে চাটমোহর উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের বোঁথড় মধ্যপাড়া গ্রামের কুলি মজুর আবেদ আলী ও সুফিয়া খাতুনের ছেলে সবুজ এসএসসি (কারিগরি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে চাটমোহর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্র।
সবুজ তার অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বাংলানিউজকে বলে, দরিদ্র বাবা-মা, চাচা এবং স্কুলের সব শিক্ষক বিশেষ করে রাঙ্গা স্যারের সহযোতিার কারণে আমার এই ভালো রেজাল্ট। সে পাবনা পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হতে চায়। ভবিষ্যতে একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে।
তার বক্তব্য, ‘আল্লাহ আমাকে সে সুযোগ দিবে কিনা জানিনা। কারণ আমার বাবার যে আয় তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। আমার পড়ার খরচ যোগানো তার পক্ষে অসম্ভব’।
ছেলের ফলাফলে খুশি হলেও চিন্তিত দরিদ্র পিতা আবেদ আলী। তিনি বলেন, ‘মেয়ের বিয়ে দিয়েছি অনেক কষ্টে। সারাদিন বাজারে কুলির কাজ করে যা উপার্জন করি তা দিয়েই চলে সংসার। তার উপর ছেলের পড়ার খরচ দেওয়ার সামর্থ্য নেই আমার’।
তাই বাধ্য হয়ে ছেলে রাজমিস্ত্রির যোদানদার, কখনও কৃষি জমিতে কাজ করে পড়ালেখা চালিয়েছে। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি জানান, বসতভিটে ছাড়া তাদের কোনো সম্বল নেই। যে কারণে ভলো ফলাফল করার পরও পিতা হতাশ। তার এখন একটাই চিন্তা- কীভাবে তিনি তাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন।
চাটমোহর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রহিম কালু বাংলানিউজকে জানান, ছেলেটি দরিদ্র ও মেধাবী। তার আবেদনে বেতনের যতটুকু সম্ভব মওকুফ করা হয়েছিল। তার কলেজ থেকে ২৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৩ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১২
সম্পাদনা: রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর/সাইফুল ইসলাম, কান্ট্রি এডিটর