সিলেট: এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া পিতৃমাতৃহীন আলমগীরের বেশি কিছু স্বপ্ন ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এমসি কলেজে ভর্তি হওয়া।
একেবারে নি:স্ব অবস্থায়ও নিজ যোগ্যতায় কোনোভাবে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু মাথা গোজবার ঠাঁই ছিল না। ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় শুধু কান্নাই আসছিল তার। সেই কান্না দেখে ছাত্রাবাসে বিনা পয়সায় একটি সিট দিয়েছিলেন ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষক জামাল উদ্দিন। কিন্তু তিনি কি জানতেন? তার বহু কাঙ্খিত থাকবার জায়গাটি আগুনে পুড়ে যাবে।
ছাত্রলীগ শিবির সংঘর্ষের জের ধরে সেদিন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে। ছাত্রাবসে অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ছাত্রাবাসের ৬টি ব্লকের ৩টি ব্লক। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো ২টি ব্লক। পুড়ে যায় ২শ’টি কক্ষ। আবাস হারায় ছাত্রাবাসের ৩ শতাধিক ছাত্র। এরপর থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় ছাত্রাবাস ও এমসি কলেজ।
আলমগীর হারায় তার থাকার জায়গা। শুধু কি তাই। নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের সময় যখন সাধারণ ছাত্ররা প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছিল, সেও ছিল তাদের দলে। এরমধ্যেই লুট হয়ে যায় তার সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর, পুড়ে যায় মূল্যবান অনেক নোট শিট আর কাপড়।
সূদূর সুনামগঞ্জের ছাতক গোবিন্দগঞ্জ থেকে আসা আলমগীরই নয়। তার মতো ছাত্রাবাসে সিট হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়েছে এরকম ৩ শতাধিক ছাত্র। যারা শুধু তাদের থাকার জায়গা হারায়নি হারিয়েছে পরণে থাকা বস্ত্র ছাড়া সবকিছুই।
একইভাবে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার ফুলতলা গ্রামের বশির উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে আসা ইমরুল হাসান ইমনও হারিয়েছে সর্বস্ব। পিতৃহীন ইমন মায়ের জমি বিক্রির টাকায় ভর্তি হয়ে কোনোভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল এই ছাত্রাবাসে থেকে। আগুন থেকে তার অবশ্ষ্টি আর কোনো কিছুই থাকেনি। ৪র্থ ব্লকের ৪০৪ যে যে কক্ষে সে থাকতো আগুনে এখন সে কক্ষের কোনো চিহ্নই এখন সেখানে নেই।
৮ জুলাই সন্ধ্যা রাতের আগুন শুধু ছাত্রাবাস আর মুক্তিযদ্ধের স্মৃতি কিংবা রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি পোড়ায়নি। সেই সাথে পুড়িয়েছে শত শত শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। লেখাপড়া করার জন্য একমাত্র থাকার যে জায়গা ছিল তাদের সেটি এখন নেই, সেই সাথে নাই হয়ে গেছে, সার্টিফিকেট, কষ্টের টাকায় কেনা বই, সংগ্রহ করা নোট, রাত জেগে তৈরি করা শিট।
এখনও এসব শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপুরণসহ সহযোগিতার কোনো আশ্বাস মিলছে না। তাই পড়ালেখা আর শিক্ষাজীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছাত্রবাসের ৩ শ’ শিক্ষার্থী।
বিষয়টি জানতে চাইলে, এমসি কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ধীরেশ চন্দ্র সরকার বাংলানিউজকে জানান, “অনেক ছাত্রই তাদের মূল্যবান সার্টিফিকেট হারিয়েছে। এজন্য কলেজ থেকে এ সংক্রান্ত সকল প্রয়োজনে তাদেরকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে শিক্ষাবোর্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রদের জন্য কাউন্টার খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ”
এছাড়া শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে স্বীকার করে অধ্যক্ষ আরো জানান, “যে বিপুল ক্ষতি তা পূরণে কলেজের পৃথক কোনো ফান্ড নেই। তবে মন্ত্রণালয়ে এজন্য তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণেরও সুপারিশ করা হবে। ”
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুড়ে যাওয়া ৩টি ব্লকে শিক্ষার্থীদের অর্ধশত কম্পিউটার, প্রায় আড়াইশ ছাত্রের কাপড়, বইপত্র ও সার্টিফিকেট পুড়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, গত ৮ জুলাই এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষ শেষে শিবির কর্মীরা পালিয়ে গেলে ছাত্রলীগ ছাত্রাবাসের ৩টি ব্লকে অগ্নিসংযোগ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ভষ্মীভূত হয়ে যায় দু’শতাধিক কক্ষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো ২টি ব্লক। এরপর থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য এমসি কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ঘটনার পরদিন এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজের উপাধ্যক্ষকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। এর পরদিন সিলেট জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যজেস্ট্রেটকে প্রধান করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়।
এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ২ জন ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পঙ্কজ পুরকায়স্থসহ শতাধিক ছাত্রলীগনেতাকর্মীকে আসামি করে পৃথক মামলা করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১২
এসএ/সম্পাদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর; নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর