যশোর: নানান সঙ্কটের মাঝেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ।
বৃটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত কলেজটি সাত দশক ধরে এ অঞ্চলে শিক্ষার আলো বিস্তার করে আসছে।
বর্তমানে কলেজটিতে ১৯টি বিষয়ে অনার্স, ১৭টি বিষয়ে মাস্টার্স ছাড়াও স্নাতক (পাস) ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
বিপুল এ শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষসহ নানান সঙ্কট রয়েছে কলেজটিতে।
তবে, এসবের মাঝেও শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন ওই কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ইবাদুল হক।
তিনি জানান, শ্রেণিকক্ষসহ আরও কিছু সঙ্কট নিরসনের জন্য ১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শ্রেণিকক্ষ, অডিটোরিয়াম ও আবাসন সঙ্কট দূর হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
কলেজ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর সরকারি এমএম কলেজে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়াও ১৯টি বিষয়ে অনার্স, ১৭টি বিষয়ে মাস্টার্স এবং স্নাতক(পাস) কোর্স চালু রয়েছে।
এ শ্রেণিগুলোতে সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার।
এ শিক্ষার্থীদের পাঠগ্রহণের জন্য কলেজের ৪টি ভবনে মোট ৫৫টি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। যা নিতান্তই অপ্রতুল।
ওই কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আব্বাস আলী বাংলানিউজকে জানান, দীর্ঘদিন ধরেই কলেজের শ্রেণিকক্ষের সঙ্কট রয়েছে। একটি শ্রেণির ক্লাস চলাকালে অন্য শ্রেনির শিক্ষার্থীদের বারান্দায় অথবা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কলেজের শিক্ষক সঙ্কটের বোঝাও শিক্ষার্থীদের বহন করতে হচ্ছে। শিক্ষক না থাকায় অনেক বিভাগে নিয়মিত ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না।
কলেজটিতে সবমিলিয়ে ১৬২টি শিক্ষকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে কলেজটিতে শিক্ষাদান করছেন ১৩৪ জন শিক্ষক।
বাকী ২৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে চালু হওয়া মার্কেটিং ও ফিন্যান্স বিষয়ের কোনো শিক্ষকই নেই কলেজটিতে।
হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক দিয়ে ওই দু’টি বিভাগ চালানো হচ্ছে। বাংলা বিভাগে ৪টি, ইংরেজি, হিসাববিজ্ঞান, গণিত, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও রসায়ন বিভাগে ৩টি করে শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
বাংলা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মামুনুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, বাংলা বিভাগে শিক্ষকের ১২টি পদ থাকলেও এর মধ্যে ৪টিই শূন্য। এ কারণে মাঝে-মধ্যেই শিক্ষকের অভাবে তারা প্রয়োজনীয় ক্লাস থেকে বঞ্চিত হন।
ভূগোল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ইন্দ্রজিৎ রায় বাংলানিউজকে জানান, কলেজে ছেলেদের দু’টি আবাসিক হল রয়েছে। যেখানে অনেক কষ্টে ২’শ ছাত্র থাকতে পারে। ফলে বাধ্য হয়েই তার মতো হাজার হাজার ছাত্রকে কলেজের আশপাশের মেসে থেকে লেখাপড়া করতে হয়।
ছাত্রীদেরও অবস্থা একই রকম।
ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্র সোয়াইব হোসেন লাইব্রেরীর বই ও স্থান সঙ্কটের কথা তুলে ধরে বাংলানিউজকে বলেন, ‘লাইব্রেরীতে বসে পড়া বা নোট তৈরির সুযোগ নেই। কারণ লাইব্রেরীতে ১০/১২ জনের বেশি বসাই কষ্টকর। সেই সঙ্গে পওয়া যায়না প্রয়োজনীয় বইও।
তবে, কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ইবাদুল হক বাংলানিউজকে জানান, কিছু সঙ্কট দূর করার উদ্যোগ ইতোমধ্যে হাতে নেওয়া হয়েছে। কলেজের জন্য ১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কলেজের কলা ভবনের সামনে নতুন একটি ৪ তলা ভবন নির্মাণের দরপত্র গ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। এ ভবনের নিচতলায় অডিটোরিয়াম ও বাকী ফ্লোরে ক্লাসরুম করা হবে।
এছাড়া নতুন বিজ্ঞান ভবন ও বাণিজ্য ভবনের ৪র্থ তলায় শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এগুলো সম্পন্ন হলে শ্রেণিকক্ষের সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। বাকী ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ছাত্র ও ছাত্রীদের দু’টি আবাসিক হল নির্মাণ করা হবে। যা আবাসন সমস্যারও কিছুটা দূর করবে বলে তিনি জানান।
আর শিক্ষক সঙ্কট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা দেশেই সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে। বরং অনেক এলাকার কলেজের তুলনায় এমএম কলেজে এ সঙ্কটের মাত্রা অনেক কম। তারপরও শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তারা তৎপর রয়েছেন। এছাড়া নতুন চালু হওয়া ফিন্যান্স ও মার্কেটিং বিভাগের জন্য শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে তা পূরণের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে।
পাঠাগার প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ বলেন, ‘কলেজের একটি স্বতন্ত্র পাঠাগার ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যশোর-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন তার বাবা শেখ আকিজ উদ্দিনের নামে কলেজে একটি স্বতন্ত্র পাঠাগার স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে, কলেজের সাবির্ক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পাসে নিয়মিত বখাটে, সন্ত্রাসীদের আড্ডা থাকে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
এছাড়া ছাত্রনেতা নামধারী ক্যাডারদের তৎপরতার কারণেও শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন।
খড়কি এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা আল আমিন বাংলানিউজকে জানান, কলেজকে কেন্দ্র করে খড়কি এলাকায় একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। যারা কলেজসহ আশপাশের এলাকায় হামলা, বোমাবাজি, চাঁদাবাজীসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
আর সন্ধ্যা পার হলেই কলেজ এলাকা ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। এমএম কলেজে লেখাপড়া করতে আসা মেসের শিক্ষার্থীরা এদের কারণে সন্ধ্যার পরে বাইরে যেতেও ভয় পায়।
কলেজের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ ইবাদুল হক বাংলানিউজকে জানান, কলেজে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে তারা সব সময়ই তৎপর। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক দ্বিধা বিভক্তি ও অস্থিতিশীলতার কারণে সব সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
যদিও দেশের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গণ, এলাকা এবং যশোরের সার্বিক পরিবেশের তুলনায় এমএম কলেজের অবস্থা অনেক ভাল বলে অধ্যক্ষ দাবি করেছেন।
শুরুর কথা: সমস্যা সঙ্কট থাকলেও যশোর সরকারি এমএম কলেজের রয়েছে ৭০ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
১৯৪১-৪২ শিক্ষাবর্ষে ১৪২ জন ছাত্র ও ৪ জন ছাত্রী নিয়ে এ বিদ্যাপীঠের পথচলা শুরু হয়। সূচনালগ্নে কেবল উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠদান করা হত।
উচ্চশিক্ষার জন্য তখন বৃহত্তর যশোরে স্নাতক পর্যায়ের কোনো কলেজ ছিলনা। এ কারণে এ এলাকার অভিভাবকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল এ কলেজকে স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত করা। এমনই এক সময় ১৯৫৬ সালের ১০ ডিসেম্বর কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন খড়কির পীর শাহ সুফি মৌলানা মুহাম্মদ আবুল খায়ের (রহ:) এর দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল হাই। তার সময়ে কলেজটিতে প্রথম বি.কম এবং বিএসসি পাস কোর্স চালু হয়।
এ সময় কলেজের পরিধি বৃদ্ধি ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১৯৫৯ সালের দিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম এ রুহুল কুদ্দুস এর সহযোগিতায় কলেজটিকে চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে খড়কিতে স্থানান্তর করা হয় এবং সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্ত হয়।
কলেজের জন্য প্রয়োজনীয় জমি সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা রাখেন খড়কির পীর সাহেব সুফি মৌলানা আবুল খায়ের (রহ:) ও হাজী মোরশেদ আলী। মুনসী নাছিম উদ্দীন, আব্দুল লতিফ, মহাতাব বিশ্বাস, মোহাম্মদ আলী, জবুর আলী জোর্য়াদ্দার, দলিল উদ্দীন, শরীফ শামছুর রহমান, ইমান আলী, আব্দুস সোবাহান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের দানকৃত জমির ওপর নির্মিত হয় কলেজ ভবন।
১৯৬০ সালে নবনির্মিত এ কলা ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম রুহুল কুদ্দুস।
উচ্চ শিক্ষা প্রসারে এ কলেজকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে ১৯৬২ সালে অর্থনীতি, ভূগোল ও বাংলা বিষয়ে প্রথম অনার্স কোর্স চালু হয়। উচ্চ শিক্ষায় এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সাড়া মেলে। অল্প দিনেই এ কলেজটি শিক্ষাক্ষেত্রে বহু সুনাম অর্জন করে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯৬৮ সালে কলেজটিকে জাতীয়করণ করে। বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিষয়ে সুদূর প্রসারী শিক্ষায় গড়ে তোলার লক্ষে ১৯৭৩ সালে বিজ্ঞান ক্লাব ও ১৯৭৬ সালে বাণিজ্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের বিবর্তনে এ অঞ্চলের জ্ঞান পিপাসু মানুষের তৃষ্ণা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে কলেজের শিক্ষার পরিধি।
এ প্রেক্ষাপটে কলেজ প্রশাসন ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষে পদার্থ, রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করে। ওই সময় অনার্স কোর্সে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করলেও মাস্টার্স কোর্স চালু ছিলনা। ফলে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হতো। উচ্চতর শিক্ষাকে সহজেই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স কোর্স চালু করে। পরবর্তীতে ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী করে গড়ে তুলতে ইংরেজি বিষয়ে মার্স্টাস কোর্স চালু হয়।
কলেজটিতে অবকাঠামোর তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ১৯৯৭ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কোর্স তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অভিভাবকদের প্রবল আগ্রহের ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ আবার ২০০৮ সাল থেকে এ কোর্স চালু করে।
পাঠক আগামী শনিবার চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের প্রতিবেদন দেখতে বাংলানিউজের সঙ্গেই থাকুন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ ও শামীম হোসেন, নিউজরুম এডিটর