ঠাকুরগাঁও: শিক্ষকসহ নানান সংকট নিয়ে চলছে উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত ঘেঁষা জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ। এ কারণে লেখাপড়ার দিক থেকে চরমভাবে পিছিয়ে এ কলেজের শিক্ষার্থীরা।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৫৯ সালে বিডি কলেজ নামে প্রতিষ্ঠিত করেন তৎকালীন মহকুমা প্রসাশক এম আই কে খলিল। ওই সময় ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে মাত্র ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় কলেজটির। ১৯৮০ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালে ডিগ্রি (পাস) পর্যায়ে উন্নীত হয়।
অনার্স কোর্স চালু: জাতীয়করণের ১৭ বছর পর ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ও গণিত বিষয়ে স্নাতক (সম্মান/অনার্স) কোর্স চালু হয়। এর পরের বছর আরও অর্থনীতি, ইসলামের ইতিহাস, ব্যবস্থাপনা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞানসহ ৬টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা করা হয়। এর পর ২০১১ সালে দর্শন ও ইতিহাস এবং ২০১২ সালে রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়।
শিক্ষার্থী সংখ্যা: ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এ কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১০ হাজার। এর মধ্যে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ১৫শ’, ডিগ্রি (পাস) কোর্সে ৪ হাজার এবং ১৪টি বিষয়ে অনার্স কোর্সে সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।
শিক্ষক সংকট: ১০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ৯৮ জন শিক্ষক প্রয়োজন থাকলেও সরকারের নীতিমালায় পদ সৃষ্টি আছে ৮১ জন শিক্ষকের। এর মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৬৩ জন শিক্ষক। বর্তমানে কলেজটিতে ১০ জন সহযোগী অধ্যাপক, ১১ জন সহকারী অধ্যাপক এবং ৪২ জন প্রভাষক রয়েছেন। ১৮ জন শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য পড়ে আছে। অনার্সের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ একজন সহকারী অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ চলছে একজন সহযোগী অধ্যাপক ও একজন প্রভাষক দিয়ে।
অবকাঠামো: প্রশাসনিক ভবনসহ কলেজটিতে ৮টি ভবন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পড়া-লেখায় ক্লাসরুমের সংকট নেই বললেই চলে। ঠাকুরগাঁও শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে অবস্থিত এ কলেজ চত্বরে রয়েছে নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছ-গাছালি। পুরানো টিন-শেড ভবন রয়েছে ৩টি। কলেজের মাঝখানে রয়েছে প্রশস্ত একটি খেলার মাঠ। মসজিদ ও পুকুরও রয়েছে এতে। এ কলেজের শহীদ মিনারটির নান্দনিক সৌন্দর্যে দৃষ্টি কাড়ে সবার। সামনের প্রশস্ত মাঠটি বাদে ভবনগুলোর সঙ্গে রয়েছে বৃক্ষছায়া আচ্ছাদিত মনোরম চত্বর। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে কলেজ চত্বরেই আড্ডায় আর গল্প-গুজবে মেতে ওঠে শিক্ষার্থীরা।
কমনরুম: গোটা কলেজে ছাত্রীদের জন্য মাত্র ২টি কমনরুম আছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
পাঠাগার: একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ান দিয়ে চলছে পাঠাগার। প্রায় ১৫ হাজার বই রয়েছে এ পাঠাগারটিতে। প্রতিবছরই চাহিদা অনুযায়ী কেনা হয় বিভিন্ন ধরনের বই। পর্যপ্ত পরিমাণে বই থাকলেও পাঠাগারের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। একটি ক্লাসরুম পাঠাগার হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় পড়াশুনা করার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। ফলে শিক্ষার্থীদের বই নিয়ে নিজ উদ্যোগে পড়তে হয়।
পরিবহন ব্যবস্থা: কলেজটির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে দূরদূরান্ত থেকে নিজস্ব উদ্যোগেই তাদের কলেজে যাতায়াত করতে হয়।
খেলার মাঠ, বিনোদন ব্যবস্থা ও খাবার পানি: খেলাধুলার জন্য প্রশস্ত মাঠ ছাড়ও পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলার উপকরণ রয়েছে এ কলেজে। প্রতিবছরেই কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। পাশাপাশি বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও নাটক মঞ্চস্থ হয় এখানে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার পানির সুব্যবস্থাও রয়েছে।
ছাত্রাবাস: এ কলেজে দোতলা একটি ও একটি টিন সেডের ছাত্রাবাসে মাত্র ১শ’ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থী আছে ৯৮ জন। প্রতিটি রুমে থাকেন ৪ জন করে ছাত্র। তবে ছাত্রাবাসটিতে নিজ খরচে লাইট ও ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হয় বলে জানান ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র জিয়াউর রহমান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র জাকেরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, নিরাপত্তার জন্য একজন গার্ড থাকলেও সব সময় তিনি থাকেননা। এতে বহিরাগতরা ছাত্রাবাসে ঢুকতে পারে অনায়াসে। এদিকে, ছাত্রাবাসে আরও অন্তত ১শ সিটের ভবন নির্মাণের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রীনিবাস: চারতলা বিশিষ্ট ছাত্রী নিবাস রয়েছে এ কলেজে। এতে ১শ জনের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে আছেন ১৪০ জন ছাত্রী। ভবনের ২৫টি রুমে ৪ জন করে ১শ জন থাকেন। আর বাকি ৪০ জন থাকেন হল রুমে। তবে ১শ সিটের আরও একটি ছাত্রীনিবাস নির্মাণের কাজ চলছে। এটি চালু হলে ছাত্রীদের আবাসন সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে জানান বাংলা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্রী শিউলী আক্তার।
অর্থনীতি বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী কবিতা আক্তার জানান, ভবনের ১ম ও ৪র্থ তলায় ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলেও ২য় ও ৪য় তলায় সে ব্যবস্থা নেই। এতে নানা সমস্যা পোহাতে হয় ছাত্রীদের। এছাড়াও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এখানে নেই কোনো গেস্টরুম।
ছাত্র সংসদ: ১৯৯৩ সাল থেকে এ কলেজে ছাত্র সংসদ নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের শাখা কমিটি থাকলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়না এখানে। নেই রাজনৈতিক শাখা সংগঠনগুলোর উত্তাপও। বছরে ২/১ বার ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সময় শুভেচ্ছা মিছিল ছাড়া আর কোনো কার্যক্রমে দেখা যায়না তাদের।
এ ব্যাপারে ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সভাপতি আসাদুজ্জামান পুলক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, সংসদ না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা। যেমন দীর্ঘদিন ধরে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্যান্টিনের দাবি করা হলেও তা পুরণ হচ্ছেনা।
ছাত্রদলের কলেজ শাখার আহ্বায়ক কায়েস জানান, কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানালেও সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সাড়া পাওয়া যায়নি। কলেজে ছাত্রদের জন্য কমনরুম নেই, নেই খেলাধুলার ভালো কক্ষ। সংসদ নির্বাচন না হওয়ার জন্য ছাত্রলীগকেই দায়ী করেন তিনি।
এ কলেজের ২ শিক্ষার্থীর অভিভাবক কলেজপাড়া এলাকার মনিরুল ইসলাম ও গোবিন্দ লাল জানান, ছাত্র সংসদ থাকলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারতো।
এ ব্যাপারে কলেজের উপাধ্যক্ষ আবু বকর ছিদ্দিক জানান, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দেওয়ার জন্য ছাত্রদের পক্ষ থেকে কোনো দাবিই আসেনি।
কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: কলেজের উপাধ্যক্ষ আবু বকর ছিদ্দিক জানান, কলেজে শিক্ষক সংকটই হচ্ছে মূল সমস্যা। এছাড়াও ছাত্রদের ছাত্রাবাস নির্মাণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন পরিবহন ব্যবস্থা।
তিনি আরও জানান, কলেজটি খুব শিগগিরই মাস্টার্স পর্যায়ে উন্নীত করা হবে। বর্তমান পানি সম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন মাস্টার্স কোর্স চালু করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১২
সম্পাদনা: শিমুল সুলতানা, শামীম হোসেন, নিউজরুম এডিটর