“বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশের পর আমরা ভেবেছিলাম কর্তৃপক্ষ হয়ত সেই দুর্নীতির উৎস সন্ধানে ব্রতী হবে এবং ভবিষ্যতে আর কোন দুর্নীতি ও নিয়োগবাণিজ্যকে প্রশ্রয় দেবেনা। কিন্তু প্রশাসনের আচরণ আমাদেরকে চরমভাবে হতাশ করেছে।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ এক ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত আগস্ট মাসে। এ ধারাবাহিকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম উঠে আসে। এসব প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
নিয়মানুযায়ী এই সমস্ত দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা। কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটকে না জানিয়ে প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বটে। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটি দুর্নীতির উৎস সন্ধানের জন্য গঠন করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোন কোন ব্যক্তি এই সমস্ত দুর্নীতির খবর সংবাদ-মাধ্যমে ফাঁস করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জন্যই এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আবুল বাসারকে সভাপতি করে গঠিত ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অন্য দুজন সদস্য হলেন স্থানীয় সাংসদ এবং সিন্ডিকেট সদস্য অ্যাডভোকেট রেজা আলী ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক প্রফেসর শাসমুদ্দিন চৌধুরী। প্রফেসর বাসার হজের ছুটিতে থাকায় বর্তমানে এই কমিটির কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে।
এদিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিসম্প্রতি কিছু সংখ্যক শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকেই শুরু হয়েছে দুর্নীতি ও বাণিজ্য। কর্মকর্তা পদে একাধিক শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে কোনরকম পূর্বানুমোদন ছাড়াই। এমনকি নিয়োগবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায়ও এ ব্যাপারে রিপোর্ট করা হয়নি মর্মে একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ডেপুটি রেজিস্ট্রার(রেজিস্ট্রার ইন চার্জ) হুমায়ুন কবীর, উপ-পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) নজরুল ইসলাম ও উপাচার্য মহোদয়ের একান্ত সচিব আব্দুল হালিম এই তিনজন মিলে সিন্ডিকেট করে নিয়োগ বাণিজ্য করছেন।
তারই অংশ হিসেবে সহকারী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (রেজিস্ট্রার ইন চার্জ) হুমায়ুন কবীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত ও ধারায় মৌলিক পরিবর্তন এনেছেন। ইতোপূর্বে প্রকাশিত এবং সিন্ডিকেটে অনুমোদিত যে সব শর্ত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো প্রার্থীর বয়সসীমা।
এই বিজ্ঞপ্তিতেও অন্য সব পদের বয়সসীমা উল্লেখ থাকলেও শুধুমাত্র সহকারী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) পদের বেলায় অনুর্ধ বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়নি। পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতেই এমনটি করা হয়েছে বলে সচেতন মহলের ধারণা।
উল্লেখ্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ধরণ ও শর্তাবলী নির্ধারণ করে ও অনুমোদন দেয় সিন্ডিকেট এবং যে কোন ধরনের সংযোজন বিয়োজনের ক্ষমতাও সংরক্ষণ করে সিন্ডিকেট কিন্তু এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটে তা জানানোই হয়নি।
অভিযোগ ডেপুটি রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৩ মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসেছিলেন উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। এরপর বেশ কিছুদিন ক্যাম্পাসে নিয়মিত অফিস করেন তিনি। বর্তমানে আবার অনিয়মিত ক্যাম্পাসে। বেশ কিছুদিন ঢাকায় থেকে এক-দুদিনের জন্য ক্যাম্পাসে আসেন। অভিযোগ রয়েছে নামমাত্র একটি উপাচার্য প্যানেল উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করলেও ক্যাম্পাসে এখন সমস্ত অপকর্ম নির্বিঘ্নে ঘটাচ্ছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার (রেজিস্ট্রার ইন চার্জ) হুমায়ুন কবীর।
সম্প্রতি শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এক কমিটিতে হুমায়ুন কবীর নিজের মত করে পরিবর্তন এনেছেন। চাকরিকাল গণনা বা আপগ্রেডেশান সংক্রান্ত ঐ কমিটিতে ডিন ক্যাটাগরিতে (পদাধিকারবলে) একজন শিক্ষক সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি তার ডিনের মেয়াদ শেষ হলে ঐ ডিনের স্থলাভিষিক্ত হন অন্য একজন সিনিয়র শিক্ষক। নিয়মানুযায়ী বর্তমান ডিনই হবেন ঐ কমিটির সদস্য কিন্তু হুমায়ুন কবীর পূর্বের ডিনকেই ঐ কমিটির সদস্য রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এমনকি ভিসির অনুপস্থিতির সুযোগে তিনি ঐ সদস্যকে (পূর্বে ডিন) বহাল রেখেই চাকরিকাল গণণার আয়োজন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ডেপুটি রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীর, উপ-পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) নজরুল ইসলাম ও ভিসির পিএস আব্দুল হালিম পরস্পর যোগসাজশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্ক্ষিক কর্মকর্তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত বলে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছে।
পূর্বে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে কেন্দ্র ডেপুটি রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীর কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি হিসেবে সমিতির সভায় একজন কর্মকর্তাকে শিক্ষক সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করার জন্য চাপাচাপি করেছেন বলে সমিতির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কার্যনির্বহী সদস্য এই প্রতিবেদককে অবহিত করেছেন।
আব্দুল হালিম ও হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে ভিসি দপ্তর কব্জা করার অভিযোগ রয়েছে। ভিসি বরাবর শিক্ষক কর্মকর্তার কোন আবেদন বা চিঠি যদি এদের মন:পূত না হয় তবে তা ভিসির হাত পর্যন্ত পৌঁছানো হয়না। মাঝপথ থেকেই তা সরিয়ে ফেলা হয়, বা সংশ্লিষ্ট ফাইলটি টেবিলের নিচে চাপা দেওয়া হয় বলে একাধিক ভূক্তভোগী অভিযোগ করেছেন।
এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য প্রফেসর শাসমুদ্দিন বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেই। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন নিয়োগ বা অনিয়ম নিয়েও আমি মন্তব্য করতে পারবো না। ’
তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মিটিং এ আছেন এ অজুহাতে ফোনের লাইন কেটে দেন এবং পরবর্তীতে তার সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেও পরে আর কল রিসিভ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর গোলাম শাহী আলমকে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর অবশেষে তিনি ফোন ধরেন এবং বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অথরিটি রেজিষ্ট্রার। দায়বদ্ধতাও তার। সিন্ডিকেট বসে বছরে ২ থেকে ৩ বার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব তথ্য রেজিষ্ট্রারের কাছেই থাকে। কোন কাগজ না দেখে আমি মন্তব্য করতে পারবো না। ’
এ ব্যাপারে আর এক সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর আব্দুর রহমান সরকারের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এছাড়া ভিসি প্রফেসর গিয়াসউদ্দীন এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ট্রেজারার প্রফেসর ড. আবুল বাসার হজ্জ্বের কারণে ছুটিতে আছেন। ডেপুটি রেজিস্ট্রার বাংলানিউজের সঙ্গে কথা নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর