ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ভিসি নয়, সমস্যা হটাও আন্দোলন হোক জাবির ইতিহাস

ওয়ালীউল্লাহ মিঠু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪২ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৪
ভিসি নয়, সমস্যা হটাও আন্দোলন হোক জাবির ইতিহাস

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়েছে আজ থেকে তিন বছর আগে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে। এই সময়টা নিতান্তই কম না।

এই সময়ে আমি দু’জন ভিসির অভিভাবকত্ব দেখেছি।

কিছু বিষয় আমাকে একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে বেশ অবাকই করেছে। কারণ আমার প্রথম পরিচয় ছিল আমি এই প্রতিষ্ঠানের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। ভর্তির প্রায় শুরু থেকেই সাংবাদিকতা শুরু করায় ক্যাম্পাসের সাংবাদিক বড় ভাইদের পাশে থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটু গভীর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অভিভাবকদের আচারণ আমাকে দারুণভাবে হতাশ করেছে। আবার অভিভাবকের প্রতি অভিভাবকের সহকর্মীদের কিছু আচারণও আমাকে অবাক করেছে।

ক্ষমতা মজবুত করতে রাজনৈতিক ছোঁয়া পাওয়া শিক্ষার্থীদের কদর থাকলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেকটাই মূল্যহীন। সেই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার ছাত্রাবস্থায় পাওয়া তৃতীয়, জাহাঙ্গীরনগরের ১৮তম, বাংলাদেশর প্রথম নারী ভিসি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের কাছে আমার-আমাদের প্রত্যাশা, একজন শিক্ষার্থী হিসেবেই একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক।     

সাবেক ভিসি ড. শরীফ এনামুল কবীরের পতন আন্দোলনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অবৈধভাবে শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল অযোগ্য, অদক্ষ। তিনি সেচ্ছাচারী ছিলেন। এভাবে শিক্ষার মান খারাপ করার অভিযোগ ছিল। মেডিকেলের প্রতি অবহেলা করা। এমনকি মেডিকেলের অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে।

তার সময় জুবায়েরকে হত্যা করা হয়েছে, যেখানে তার বিরুদ্ধে খুনিদের লালন করার অভিযোগ ছিল।   আমি তখন দেখেছি সাধারণ শিক্ষার্থীরা শরীফ স্যারকে নীরবে সমর্থন দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জট একেবারে কমানোর কারণে, বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগ (শারীরিক ও মানসিক শাস্তি) নির্মূলে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে, যেভাবেই হোক না কেন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মূল ধারাকে নিয়ন্ত্রণ রাখার কারণে পলিটিক্যাল আর ননপলিটিক্যাল বৈষম্য অনেকাংশে কমানোর কারণে।

শরীফ এনামুল কবীর প্রচুর বাজেটের কাজ আনতেন এবং তিনি বিএনপি এবং বামপন্থি শিক্ষকদের তার কাছে ঘেষতে দিতেন না বরং তারই খুব কম সহকর্মীকে পাশে রাখতেন। এজন্য তার চারপাশের একটা বড় অংশও একসময় তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন। অথচ তাদের পেছনে শরীফের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

তবে এসময় আমি শরীফ এনামুল কবীরের একগুঁয়েমিও দেখেছি। এত আন্দোলন অথচ তিনি কোনো একবারের জন্যেও আন্দোলনকারীদের সাথে সমঝোতার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। এসব কারণে আস্তে আস্তে আন্দোলন জটিল হয়ে যায়। কিন্তু যেসব অভিযোগে শরীফ এনামুল কবীরকে হটানো হয়েছে সেসব সমস্যার কোনো সমাধান আমি দেখছি না আজও। যেমন, জুবায়ের হত্যামামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। ক্যাম্পাসের গাছ কাটার কারণে ভূ-প্রকৃতি নষ্টের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।

ড. আনোয়ার হোসেনের সময়ও দেখেছি লেক কেটে কৃত্রিম লেক বানাতে। শরীফ এনামুল কবীরের নিয়োগকৃত অযোগ্য শিক্ষকদের কি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে? সেই অযোগ্য শিক্ষকরা তো এখন শিক্ষা দিচ্ছেন। তবে কি এখন শিক্ষার মান কমছে না?

মোট কথা যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে শরীফ এনামুল কবীরের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল তার অধিকাংশ সমস্যাই তার পতনের পরও সমাধান হয়নি। শরীফ এনামুল কবীরের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করেছিল তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তবে কেন সব সমস্যায় ভিসি হটাও আন্দোলন? সমস্যা হটাও আন্দোলন হয়নি কেন?   

শরীফ এনামুল কবীরের পর জাবির প্রথম নির্বাচিত ভিসি ড. আনোয়ার হোসেন দায়িত্ব নেন। কিন্তু তিনি জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়ে ঢাকায় দৌঁড়াতে থাকেন। ফলে ক্যাম্পাসে বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর শরীফ এনামুল কবীরের মতো তিনিও একগুঁয়েমির পরিচয় দেন।

শরীফপন্থি আওয়ামী ঘরানার শিক্ষক এবং বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের কোনো কথাই তিনি সহ্য করেননি, তার পাশে ঘেষতে দেননি, কোনো পরামর্শ নেননি। কথায় কথায় রাজনৈতিক আক্রমণ। এখানে সব রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকতাটাই আনোয়ার হোসেন কথায় কথায় অস্বাভাবিক করে ফেলেছিলেন।

এক সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্রলীগ নেতাকেই তিনি জামাত-শিবির বলেন প্রকাশ্যেই। যেটা একজন ভিসির কথা হিসেবে মেনে নেওয়ার মতো না। তার আচারণে মনে হয়েছে তিনি প্রথম নির্বাচিত ভিসি বলে, তিনিই সব। তবে তিনি ক্যাম্পাসের গুটিকয় বামপন্থি শিক্ষকেকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন। ফলে শরীফ এনামুল কবীরের নিয়োগ করা শিক্ষক এবং বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা মিলে বেশ ভালই মজা পেলেন আন্দোলন করতে।

আন্দোলনের মাঠে আনোয়ার কোনো একনিষ্ঠ সঙ্গী পাননি। ফলে আন্দোলনকারীরা সব কর্মসূচি সফলভাবে পালন করতে থাকেন। আর ক্ষতি হতে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

আমি অবাক হয়ে দেখেছি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেও আনোয়ার হোসেন ছাড় দেননি। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ সব ক্ষেত্রে সঠিক ছিল তেমন নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট ছিল যে, তিনি আন্দোলনকারীদের রুখতে সম্পূর্ণ অপারগ ছিলেন। তার পরেও তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন পদ আকড়ে থাকতে।

তিনি শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা মুখে স্বীকার করলেও একবারে জন্যও কাজে প্রয়োগ দেখাতে পারেননি।  

যেখানে অসমর্থনের অর্থ হচ্ছে ক্লাস বর্জন, কর্মবিরতি ইত্যাদি। যা সব সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষতি। এই ক্ষতির কথা চিন্তা করে হলেও তো আনোয়ার হোসেন অযৌক্তিক আন্দোলনে একটু আগে মাথা নত করে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে আছেন বোঝাতে পারতেন। অথচ পদত্যাগ হয়েও যেন কামড়িয়ে গদি ধরে রাখার চেষ্টায় তিনি কি না করেছেন? আর যারা আন্দোলন করেছেন তারা কি তাদের অভিযোগগুলোর সমাধান পেয়েছেন, নাকি আবারও নতুন ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন অদূর ভবিষ্যতে?

যাই হোক একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আবেদন, ভিসি হটাও আন্দোলন না হয়ে যেন সমস্যা হটাও আন্দোলন হয় ভবিষ্যত জাবির ইতিহাস।                         

নতুন ভিসির কাছে প্রত্যাশা: সিনেট যথাশীঘ্র সম্ভব হালনাগাদ করা হোক। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির বর্ধিতাংশ সম্পন্ন করা হোক দ্রুত। সব মহলের যৌক্তিক পরামর্শ গ্রহণ করা হোক। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় জাবি প্রশাসন তদারকি বাড়িয়ে দিক। ক্যাম্পাসের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যে দু’এক জন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা বা কর্মীর কারণে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজী টেন্ডারবাজী, নির্মাণ কাজে বখরা নেওয়া, সন্ত্রাস, নিয়োগ দুর্নীতি এসব তৎপরতা দেখা যায়, তাদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার স্বার্থ কেন্দ্রে রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করা একটু কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। দেশের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে তার দায়িত্ব অনেক বেশি, ঝুঁকি বেশি। একই কারণে তার কাছে প্রত্যাশাও বেশি।

সর্বোপরি শিক্ষা-গবেষণার উত্তর উত্তর সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে এবং উন্নতিকল্পে যেকোনো দৃঢ় পদক্ষেপ যেন নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে যে কারো বিরুদ্ধে পদক্ষেপ এবং যে কারো যৌক্তিক পরামর্শ যেন গ্রহণ করা হয়। আপনার পথ চলা হোক শুধু প্রিয় জাহাঙ্গীরনগরের তরে।
                        
লেখক: ওয়ালীউল্লাহ মিঠু
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।