ঢাকা: রাজধানীর ইন্দিরা রোড ধরে হেঁটে তেজগাঁও কলেজ রেখে একটু গেলেই মিলবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল ইহসানের ক্যাম্পাস। ২২, ইন্দিরা রোডে এই ক্যাম্পাসের অবস্থান।
ভবনের নিচতলায় মিতু কনফেকশনারির সেলসম্যানকে জিজ্ঞাসা করলে জানান, দোতলায় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ এই ভবনের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড নেই।
দারুল ইহসানের সাইন বোর্ড না থাকলেও ওই ভবনে বড় বড় সাইন বোর্ডে মেট্রোপলিস আইডিয়াল ল’ কলেজ, বিসিএস কোচিং সেন্টার, হোমিওপ্যাথিকের চেম্বার, কম্পিউটার সার্ভিসের দোকান, মিষ্টির দোকানসহ বিভিন্ন দোকানের সাইন বোর্ড মেলে।
ইন্দিরা রোড থেকে হেঁটে ফার্মগেট এসে একটু এগোতেই আবারও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। ১৩১/বি গ্রিনরোড। এটি দারুল ইহসানের আরেকটি ক্যাম্পাস।
গ্রিনরোড থেকে রওয়ানা হলাম মগবাজারের উদ্দেশ্যে। মগবাজার চৌরাস্তা পার হয়ে মালিবাগের দিকে যাওয়া সড়কের শুরুর দিকেই মিলল দারুল ইহসানের আরেকটি ক্যাম্পাস।
২৪৫ মগবাজার দারুল ইহসানের এই ক্যাম্পাসের ঠিকানা। চারতলা ভবনটির দোতলায় উঠে খুঁজতে থাকলাম দারুল ইহসানের ক্যাম্পাস।
না পেয়ে তৃতীয় তলায় একটি বিমা কোম্পানির অফিসে ঢুকে জানতে চাইলাম, দারুল ইহসানের ক্যাম্পাসটি কোথায়। ওখানকার একজন কর্মকর্তা বললেন, দ্বিতীয় তলাতে গেলেই পাবেন।
এখানে এসে দেখি আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির একটি সাইন বোর্ড। কাঁচের দরজা থেকে ভেতরে কয়েকটি টেবিল চেয়ারসহ একটি কক্ষ চোখে পড়লো। আর কিছুই নেই। পেলাম না দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর মালিবাগ মোড়ের ২৬০/৬ ঠিকানায় মিললো আরো একটি ক্যাম্পাস। এভাবে মিরপুরের ৬ক, ১/২১ মিরপুর-১০, পুরান ঢাকার ৫৩/৫ জনসন রোডের কলতাবাজার, খ ৪৯/১ বারিধারার প্রগতির স্মরণী, ৮ কল্যাণপুর, উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের ১/বি নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়ি, ঢাকা সেনানিবাসের মাটিকাটা, ৫৩ কুতুবখালী, যাত্রাবাড়ীসহ শুধু রাজধানীতেই ১৩টি ক্যাম্পাস রয়েছে।
এতো গেল রাজধানীর ক্যাম্পাস সংখ্যা। রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলায় রয়েছে আরো ২৩টি ক্যাম্পাস।
অধ্যাপক ড. আকবর উদ্দিন আহমাদ নিজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান ও উপাচার্য। ৬ক, ১/২১ মিরপুর-১০ ছাড়াও পুরান ঢাকার ৫৩/৫ জনসন রোডের কলতাবাজার, খ ৪৯/১ বারিধারার প্রগতির স্মরণী, ৮ কল্যাণপুর, উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের১/বি নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়ি, ১৩১/বি গ্রিনরোড, মিরপুর-১, ২২ ইন্দিরা রোড, ২৪৫ মগবাজার, ২৬০/৬ মালিবাগ মোড়, মাটিটাকা, ৫৩ কুতুবখালী, যাত্রাবাড়ীসহ শুধু রাজধানীতেই ১৩টি ক্যাম্পাস রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলায় রয়েছে আরো ২৩টি ক্যাম্পাস।
এভাবে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছেয়ে গেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ। বাংলানিউজের অনুসন্ধানেই সারাদেশে ৩৫টি ক্যাম্পাসের সন্ধান মিলেছে।
এতো গেল শুধু দারুল ইহসান নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। এক নামে মোট চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ এর বেশি অবৈধ ক্যাম্পাস রয়েছে। এসব জায়গায় কিভাবে পড়াশুনা হচ্ছে তা খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও পর্যবেক্ষণ করছে না। কারণ আদালতের রায়ের মাধ্যমে এসব অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি কক্ষেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ক্যাম্পাস। প্রতিটি ক্যাম্পাসে একজন পরিচালক রাখা হয়েছে। এই পরিচালকই ক্যাম্পাসের প্রশাসক, শিক্ষক, পরীক্ষক।
একটি মাত্র কক্ষে কিভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫/৬ বিভাগের ক্লাস চলা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসসহ কোনো শাখাতেই বিটিসিএল এর স্থায়ী কোনো টেলিফোন নম্বর নেই। সবখানেই মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া।
অনুসন্ধানী তথ্য অনুযায়ী, এসব ক্যাম্পাসে কোনো ক্লাসই হয় না। শুধু নামকাওয়াস্তে কেউ ভর্তি হন। ভর্তি শেষে ক্যাম্পাসের পরিচালকের নির্দেশমতো দু’একবার হাজিরা দিতে হয়। এরপর কর্তৃপক্ষের দেওয়ার নির্দেশ মতো টাকা জমা দিলেই মেলে সার্টিফিকেট।
দারুল ইহসানের খ ৪৯/১ বারিধারার প্রগতি স্মরণীর ক্যাম্পাসের পরিচালক নাদিমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ক্যাম্পাস বৈধ না অবৈধ তা আমার দেখার বিষয় না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো আমরা কাজ করি।
একটি কক্ষে কিভাবে এতগুলো ক্লাস নেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদিত বিভাগগুলোই এখানে পড়ানো হয়। শিক্ষক কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে উপাচার্য বলতে পারবেন। আমি এ বিষয়ে কথা বলার কেউ না।
একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. আকবর উদ্দিন আহমাদ কোথায় বসেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে তিনি মিরপুর-১০ এ বসতেন। এখন মহাখালীর প্রশাসনিক ভবনে বসেন। মহাখালীর ঠিকানা ও তার মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি দিতে অপারগতা জানান।
এতো গেল আকবর উদ্দিন আহমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। একই নামে দারুল ইহসান চালাচ্ছেন অধ্যাপক রহমত-ই-খোদা। তিনি নিজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে আছে ড. আবুল হোসেনের নাম। ট্রাস্টি বোর্ডের বাকি সদস্যদের কারো নামই তালিকায় নেই। নেই উপ-উপাচার্য। শিক্ষকদের সম্পর্কে কিছুই বলা নেই।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক এবং সাভারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তাদের ওয়েব সাইটে এ সংক্রান্ত স্থাপত্য ডিজাইনের ছবি দেওয়া হয়েছে। অতটুকুতেই শেষ।
দারুল ইহসান এর আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নাম রয়েছে অধ্যাপক আনোয়ার ইসলামের। এখানে কোনো উপ-উপাচার্য নেই। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আছেন এমএ রশিদ খান। কিন্তু তিনি অধ্যাপক নন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়মানুযায়ী, বোর্ড অব ট্রাস্টি, একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট ও ফিন্যান্স কমিটি সব রয়েছে বললেও এর বিস্তারিত তালিকা কোথাও নেই।
আনোয়ার ইসলামের দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি বিভাগ একটি জায়গায়। অনুমোদনহীনভাবে ঢাকা শহরের ধানমন্ডি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেককটি ভাড়া বাড়ির একেকটি স্থানে এসব বিভাগের ক্লাস চলছে। এর মধ্যে দাওয়া ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগ উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়কের ২১ নম্বর বাড়িতে।
ইনস্টিটিউট অব বিজনেস স্টাডিজ ও লাইব্রেরি ও ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগ ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের ৯/বি তে। ইংরেজি বিভাগ ধানমন্ডির ৮ নম্বর সড়কের ৩৯/এ তে। কম্পিউটার সায়েন্স ও প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ধানমন্ডির ৯/এ সড়কের ২১ নম্বর বাড়ির।
সাভারের বালিভদ্রে ১৩ একরের নিজস্ব ক্যাম্পাসের কথা বলা হয়েছে। নিজস্ব ক্যাম্পাসের স্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের খুবই কাছে এটি। এর আশপাশে আরো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। অদূরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবে এই স্থানের বর্ণনা করা হলেও এখানে কোন কোন বিভাগ রয়েছে তার হদিস মেলেনি।
আইন বিভাগে দুইজন অধ্যাপকের নেতৃত্বে ৬ জন লেকচারার রয়েছেন। এদের বিস্তারিত কোনো তথ্য কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতার বর্ণনা নেই। আইনের ক্যাম্পাসের স্থান উল্লেখ নেই। অধ্যাপক হিসেবে দেখানো হয়েছে অধ্যাপক আলতাফ হোসেন ও অধ্যাপক জালাল উদ্দিন আহমেদকে। ইসলামিক একাডেমি বিভাগে ড. আবদুল মুনেম খান নামে মাত্র একজন সহাকারী অধ্যাপকের নাম রয়েছে।
ইসলামি একাডেমিতে একজন সহকারী অধ্যাপক ও চারজন লেকচারারের নাম রয়েছে। দাওয়া ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগে ৯ জন শিক্ষকের নাম রয়েছে।
অ্যারাবিকে ৯ জন শিক্ষক। ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনে একজন সহকারী অধ্যাপক ও চারজন লেকচারার। বিবিএতে ১৭ জন শিক্ষকের ১২ জনই লেকচারার, দুইজন খণ্ডকালীন। কম্পিউটার সায়েন্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ৫ জন শিক্ষকের মধ্যে কোনো অধ্যাপক নেই। একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী উল্লেখ থাকলেও বাকি সবাই লেকচারার।
দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হেলাল উদ্দিন। তার ক্যাম্পাস সাভারের গণকবাড়ি। এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনের অবৈধভাবে ক্যাম্পাস, সার্টিফিকেট বাণিজ্য, অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায়, মালিকানা দ্বন্দ্ব, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ বহু অনিয়মের সন্ধান মেলে।
ভর্তি হতে এসে যেকোনো শিক্ষার্থী অভিভাবকই বিভ্রান্তিতে পড়বেন। কারণ একই নামে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি লোগোই একই। প্রতিষ্ঠা সাল, প্রতিষ্ঠাতা একই ব্যক্তিকে দাবি করা হয়েছে। চার নামেই রয়েছে ওয়েবসাইট।
শুধু এখানেই শেষ নয়, একটি বিশ্ববিদ্যালয় চার নামেই রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে শতাধিকের বেশি আউটার ক্যাম্পাস ইচ্ছেমতো সনদ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে দারুল ইহসান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না।
১৯৯৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরবর্তীতে চার ভাগে বিভক্ত হয় এর বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্যরা। ধানমণ্ডি, উত্তরা, সাভার ও ঢাকার মালিবাগে আরেকটি ক্যাম্পাস নিয়ে পৃথকভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করে।
এ বিষয়ে দারুল ইহসানের ওয়েবসাইটে দেওয়া টেলিফোনে যোগাযোগ করেও উপাচার্যদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম সম্পর্কে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গ উঠতে মিটিংয়ে আছেন বলে ফোন রেখে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৪