ঢাকা, রবিবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৮ জুলাই ২০২৪, ২১ মহররম ১৪৪৬

শিক্ষা

কোড পরিবর্তন: প্রযুক্তির ফাঁক গলে কোটি টাকা লোপাট!

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৫
কোড পরিবর্তন: প্রযুক্তির ফাঁক গলে কোটি টাকা লোপাট!

ঢাকা: নিম্নতম স্কেলে থেকে অবৈধ পথে উচ্চতর স্কেলে বেতন তুলছেন শত শত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। আবেদন না করেও শিক্ষক-কর্মচারীরা একটি চক্রের মাধ্যমে অসাধু উপায়ে বেতন স্কেল বা কোড পরিবর্তন করে এ অর্থ তুলছেন।

এতে কাজ করছে একটি অসাধু চক্র, শিক্ষা ভবন থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এই চক্র বিস্তৃত।
 
সফটওয়্যারভিত্তিক এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) কার্যক্রম পরিচালিত হলেও অসাধু উপায়ে উচ্চতর স্কেলে বেতন তোলায় কোটি কোটি টাকা ক্ষতি গুণছে সরকার। অসাধু চক্রগুলো শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে হাতিয়ে নিচ্ছে আরও কোটি টাকা। এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে আর্থিক সংশ্লেষের ব্যাখা চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
 
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, তদন্ত শেষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে জালিয়াতি ঠেকাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাও জানায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
 
কোড পরিবর্তন, কীভাবে?
দুই মাস পর পর বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও দেওয়া হয়। চলতি বছরের জুলাই মাসের হিসাব অনুযায়ী, ৫৬৭ শিক্ষক-কর্মচারী কোড পরিবর্তন করে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিয়েছিলেন। একজন শিক্ষক-কর্মচারী এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ তোলেন বলে জানায় মাউশি’র বিদ্যালয় শাখা।
 
গত মে মাসে আরও প্রায় সাড়ে তিনশ’ শিক্ষক-কর্মচারী কোড পরিবর্তন করে অতিরিক্ত অর্থ তুলেছিলেন।
 
গড়ে তিন হাজার ধরে নয়শ’ জনের পেছনে দুই মাসে সরকারের অতিরিক্ত প্রায় ২৮ লাখ টাকা গচ্চা গেছে। তবে গত জুলাই মাসের অধিকাংশই টাকা ফেরত দিয়েছেন। আর মে মাসের জালিয়াতির হিসাব-নিকাশ করছে মাউশি।
 
উচ্চতর স্কেলে পদোন্নতির জন্য অনলাইনে আবেদন করলে উপজেলা-জেলা-বিভাগ-মাউশিতে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে স্কেল পরিবর্তনের বিষয়টি সমাধান হয়। এতে ফাইল হাতে হাতে আসার প্রয়োজন নেই।
 
মাউশি’র ডাকে জুলাই মাসের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষক-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, অধিকাংশই এমপিও’র জন্য আবেদন করেননি।
 
প্রথমে রংপুর অঞ্চলে শুরু হলেও গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও অনলাইনে চালু হয়। বর্তমানে সারা দেশে নয়টি অঞ্চল ধরে অনলাইনে এমপিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি।
 
মাদ্রাসা-কলেজের ক্ষেত্রে একজন প্রভাষক ৮ বছর চাকরি করলে উচ্চতর স্কেলে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। আর স্কুলের ক্ষেত্রে ৮ বছর হলে টাইম স্কেল (বিএড এবং টাইমস্কেল) প্রাপ্ত হন। কিন্তু অনলাইনে মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ায় যোগ্যতা অর্জনের আগেই স্কেল বা কোড পরিবর্তন করে টাকা তুলছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
 
শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে সাধারণত দুই মাস পর পর এমপিও যায়। এর আগে ২০১৩ সালের মে মাসে ২০ জনের মধ্যে স্কুলের ২৭৩ জন এবং মাদ্রাসার ৭ জন শিক্ষক কোড পরিবর্তন করেছিলেন বলে জানায় মাউশি।
 
কারা জড়িত
ওরাকল এবং সিনোসিস আইটি ফার্মের সফটওয়্যার ব্যবহার করে এমপিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে মাউশি’র কম্পিউটার সেল (ইএমআইএস)।
 
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমপিও’র মত কার্যক্রম পরিচালনা করা ওরাকল সফটওয়্যারের সঙ্গে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সিনোসিস আইটি ফার্ম কাজ করছে বলে জানায় মাউশি।
 
ইএমআইএস থেকে যেকোনোভাবে কোড পরিবর্তন হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মাউশি। এজন্য মাউশি’র কম্পিউটার সেলের সিস্টেম এনালিস্টের দায়িত্ব থেকে আবুল ফজল মো. বিল্লাল হোসেনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
 
মাউশি’র এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, সন্দেহের তীর তার দিকেই। কারণ তার পাসওয়ার্ড ছাড়া ড্যাশ বোর্ডে কারও পক্ষে ঢুকে চূড়ান্তভাবে কোড পরিবর্তন সম্ভব না।
 
মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ পাসওয়ার্ড হ্যাকিং বা চুরি করেও কোড পরিবর্তন করে দেওয়া যায়।
 
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাউশি’র একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার বোঝার দক্ষ জনশক্তি না থাকায় এই কোড পরিবর্তনসহ অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
 
তদন্তে আইটি বিশেষজ্ঞ-গোয়েন্দা
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া নিয়ম বহির্ভূতভাবে কোড পরিবর্তন করে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে ৮ কোটি ৮৬ লাখ ১৮ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া মাউশি’র কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জবাব চেয়েছে।
 
এতে প্রতিষ্ঠানওয়ারি হিসাব বিবরণী ও কোডভিত্তিক সংক্ষিপ্ত বিভাজন চাওয়া হয়।
 
মাউশি’র পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. এলিয়াছ হোসেনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
 
তদন্ত কাজ চলছে জানিয়ে এলিয়াছ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, তদন্ত কাজে সরকারের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই), ওরাকল সফটওয়্যার স্পেশালিস্ট এবং গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
 
অধিদপ্তরের বিষয়গুলো মাউশি’র কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন জানিয়ে এলিয়াছ হোসেন বলেন, প্রযুক্তির বিষয়গুলো এটুআই, আইটি এক্সপার্ট ও গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছেন।
 
শিক্ষক-কর্মচারীরা মাউশিতে এসে জুলাই মাসের অতিরিক্ত অর্থ তোলার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানান এলিয়াছ হোসেন। তবে কীভাবে কোড পরিবর্তন করেছেন- তা কেউই স্বীকার করেননি।
 
জালিয়াতির জন্য কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না- জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো এমন চিঠির জবাব পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
 
কর্তৃপক্ষ কী বলে?
সন্দেহের তালিকায় এক নম্বরে থাকা ইএমআইএস’র সিস্টেম এনালিস্টকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার পর নিয়মিত ড্যাশ বোর্ড তদারকি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মাউশি কর্মকর্তারা।
 
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রযুক্তির ফাঁকে যেন কেউ আর ফায়দা লুটতে না পারে সে জন্য আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অপরাধীরা পার পাবে না।
 
এমপিও’র ড্যাশ বোর্ড শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে মাউশি কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং আবেদনকারী শিক্ষকও নিজস্ব পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে দেখতে পায়।
 
এ অবস্থায় ভবিষতে আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সেজন্য চেক দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান পরিচালক এলিয়াছ হোসেন। তিনি বলেন, সফটওয়্যারের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
 
এমপিও নিয়ে কারও সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগ না করার পরামর্শ দিয়ে মাউশি’র পরিচালক বলেন, এতে প্রতারিত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৫
এমআইএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।