ঢাকা, রবিবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৮ জুলাই ২০২৪, ২১ মহররম ১৪৪৬

শিক্ষা

দুর্গম গোয়াইনঘাটে প্রাথমিক শিক্ষার পথ ‘বন্ধুর’

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
দুর্গম গোয়াইনঘাটে প্রাথমিক শিক্ষার পথ ‘বন্ধুর’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গোয়াইনঘাট (সিলেট) থেকে ফিরে: নদী-হাওর-খাল আর পাহাড় বেষ্টিত দুর্গম এলাকা সিলেটের গোয়াইনগাট উপজেলার বিছানাকান্দি। অসমতল ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে এখানকার মানুষের রয়েছে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য।

এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে প্রভাব প্রকট।

ভৌগলিক বৈশিষ্ট থেকে উদ্ভ‍ূত অসমতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ও উপস্থিতি কম, স্কুলে শিক্ষক স্বল্পতা, শিক্ষকদের সময়ানুবর্তিতার অভাব লক্ষ্যণীয়।

পাশাপাশি রয়েছে নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শনের ঘাটতি এবং অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে অসচেতনতা। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে এসব এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে।

দুর্গম এলাকার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের পরিদর্শন সুবিধাদি তথা আলাদা ভাতা না থাকায় এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষকদের পাঠদান ও বিদ্যালয় পরিদর্শনের ওপর।

গোয়াইনঘাট উপজেলায় স্কুল ফিডিং একেবারেই না থাকা এবং উপবৃত্তির হার সন্তোষজনক না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে এর প্রভাব পড়েছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলায় সরেজমিনে কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-অভিভাবকরা জানান, অভাব-অনটনের কারণে পাথর তোলার মৌসুমে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাস) বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি থাকে কম। এই সময় পাথর তোলার কাজেই ব্যবহার হয় শিশু-শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া বর্ষা মৌসুমে (জুন থেকে আগস্ট-সেপ্টম্বর মাস) অসমতল পথ-ঘাট পানিতে ডুবে থাকায় শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আরও কমে যায়।

এডুকেশন ওয়াচের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিলেট বিভাগে শিশুদের ভর্তির হার ৮০.৫ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে ছিল ৮৬.৪ শতাংশ, সর্বোচ্চ ৯২.৫। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে এমন শিক্ষার্থীর হার ৩৩.১ শতাংশ, যেখানে জাতীয়ভাবে বাংলাদেশে ৫১.৩ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৭০.২ শতাংশ। গণস্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত ২০০৯ সালের প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের একটি বগাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। খালের উপর এই বিদ্যালয় গত ১৪ অক্টোবর সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা গেল, দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাটিতে বসে একটি কক্ষে গাদাগাদি করে ক্লাস করছেন শিক্ষার্থীরা। ক্লাসের সহকারী শিক্ষক মাসুম পারভেজ জানান, পঞ্চম শ্রেণির মডেল টেস্ট পরীক্ষার কারণে এখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছেন।

চতুর্থ শ্রেণিতে ক্লাসে ১৩৪ জনের বিপরীতে উপস্থিত ছিল ৮৭ জন। তাদের গণিতের ক্লাসে হোমওয়ার্ক দিলেও করে আসেননি কেউ।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম সরকার বলেন, শুকনা মৌসুমে পাথর উঠাতে পাঠায় অভিভাবকরা। প্রতিদিন সাড়ে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা আয় করে। পাথর উঠানোর মৌসুমে ১০ শতাংশ উপস্থিতি কমে যায়। আয় বেশি তাই, শিক্ষার্থীরা পাথর তোলার মৌসুমে পড়ার থেকে মনোযোগী হয় পাথর তোলার কাজে।

৭টি পদের বিপরীতে এই স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা ৫ জন। শিক্ষার্থী ৬৪৬ জন। ৪০ জনের জন্য এক জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও রয়েছে সাড়ে ৬শ’ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৫ জন।

পাথর উঠানোর মৌসুমে ধুলোবালিতে ভরে যায় স্কুলের ভবন এবং শ্রেণিকক্ষ। ধুলোবালিতে শ্বাসকষ্ট হয় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের, বলেন প্রধান শিক্ষক। সীমানা প্রাচীর নেই এই বিদ্যালয়ের, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জন্য টয়লেট মাত্র দু’টি।

মা সমাবেশ প্রতি মাসে করার কথা থাকলেও গত এক মাস আগে হয়েছে, জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিদর্শন করা হলে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে দেয়।

স্কুল ফিডিং কর্মসূচি থাকলে উপস্থিতি বাড়তো বলে মনে করেন প্রধান শিক্ষক।

অভিভাবকদের অসচেতনতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মা-বাবা বা কারও কাছে শেখার উপায় নেই। বাড়িতে গিয়ে পড়লে ভাল হতো। এছাড়া ৩০ মিনিটের ক্লাসে উপস্থিতি গণনা করতে সময় চলে যায়। ফলে ক্লাসে সময় কম।
 
একই দিনে দুপুরে বিছানাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, মধ্যাহ্ন বিরতিতে মাঠে খেলছিল শিক্ষার্থীরা।

এখানেও রয়েছে শিক্ষকের স্বল্পতা, ৬টি পদ থাকলেও শিক্ষক আছেন মাত্র ৪ জন। প্রাক-প্রাথমিকে ২ জন শিক্ষক। প্রধান শিক্ষকের পদে ভারপ্রাপ্ত হিসাবে রয়েছেন একজন সহকারী শিক্ষক।

শিক্ষার্থী ৩৩৪ জন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফারজানা ফেরদৌসী জানান, বর্ষার সময় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে না। পাহাড়ি ঢলে পানিতে এলাকা ডুবে যায়। তখন চলাচল স্বাভাবিক থাকে না।

ভূ-প্রকতির কারণে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা। স্কুল ফিডিং এবং মোটাদাগে উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে এলে শিক্ষার গুণগত মান ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানো যাবে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যানুযায়ী, গোয়াইনঘাটে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৮টি। বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে ১৫০০ স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রকল্পের আওতায় রয়েছে চারটি। আনন্দ স্কুল ১৩০টি, কেজি স্কুল ৩১টি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১২টি। সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ৬৩৮টি পদ থাকলেও শূন্য রয়েছে ৪৮টি পদ।

এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৪০টি, যার মধ্যে ব্র্যাকের ১২৮টি। মোট বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩৫টি। এনজিও এবং ইসলামিক মিশন পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র ১২৩টি।

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিশুর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৭৯৭ জন, এর মধ্যে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৮৩২ জন, ভর্তির বাইরে রয়েছে ৭৫৯ জন, ভর্তির হার ৯৭.৮০ শতাংশ।

১১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১৪টিতে উপবৃত্তি পায় ১৫ হাজার ৭৩১ জন।

ইউনিয়ন পরিষদ শিক্ষা কমিটি এবং স্থানীয়দের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করে দুর্গম এলাকার শিক্ষার মান উন্নত করা যাবে বলে মনে করেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম।   

পাশাপাশি দূরের শিক্ষকদের জন্য আবাসন ও বিশেষ ভাতা প্রদান করা যেতে পারে বলে জানান ড. শফিকুল।

প্রাথমিক শিক্ষা সিলেট বিভাগীয় উপ-পরিচালক তাহমিনা খাতুন বলেন, শিক্ষক শূন্যতা পূরণে তারা প্রাথমিক অধিদপ্তরকে অনুরোধ করে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের স্কুল ফিডিং কর্মসূচির মধ্যে নিয়ে এলে উপস্থিতি বাড়ানো যাবে বলেও মনে করেন তিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
এমআইএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।