ঢাকা, শনিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

শিক্ষা

শুক্রবারের স্পেশাল রিপোর্ট

‘বইতে পারি না বইয়ের বোঝা’

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
‘বইতে পারি না বইয়ের বোঝা’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: স্কুলের গেটে বাবা, ক্লাস শেষে বইয়ের বোঝা বয়ে মেয়ে বাঁকা হয়ে হেঁটে আসছে দেখে খানিকটা এগিয়ে গেলেন। নিজের কাঁধে বিশালাকৃতির ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চললেন, স্বস্তি পেয়ে পিছু নিল তার তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা।

তার সিলেবাসে ১৩টি বই, প্রত্যেক বিষয়ের আলাদা খাতা; ব্যাগের ওজন সব মিলিয়ে প্রায় ৪/৫ কেজি।

সন্তানদের শরীরের তুলনায় বইয়ের অতিরিক্ত বোঝা বয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ার এমন চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর মিরপুরের একাধিক স্কুল ও কোচিং সেন্টারগুলোতে। অথচ সরকারি স্কুলে চিত্র উল্টো।

অতিরিক্ত বই নিয়ে শিশু শিক্ষার্থীরা বলছে, বইয়ের এত বোঝা তারা টানতে পারে না। এজন্য মা-বাবার পিঠে তুলে দেন।

অভিভাবকরা বলছেন,  অতিরিক্ত বইয়ের বোঝার কারণে শারীরিক চাপের পাশাপাশি মানসিক চাপও বয়ে বেড়াতে হয় ছোটো ছোটো বাচ্চাদের ।

মিরপুর ১৩ নম্বরে এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজের সামনে রোববার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে একাধিক অভিভাবক ছেলে-মেয়েদের ব্যাগ নিজের কাঁধে নিয়ে সন্তানের হাত ধরে বাসায় ফিরছিলেন।

তাদের একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করে বাংলানিউজকে বলেন, তৃতীয় শ্রেণির এতটুকু বাচ্চার জন্য ১২/১৪টি বই, খাতা ! পড়ালেখা কঠিন, তার সঙ্গে এত বই বয়ে বেড়ানোও সহজ নয়।

সকালে স্কুলে নিয়ে আসেন মা, স্কুল ছুটি হলে বাবা নিয়ে যান বাসায়, এভাবে বইয়ের বোঝা নিয়ে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদের প্রতিদিনের আসা-যাওয়া।
 
তৃতীয় শ্রেণিতে বোর্ড অনুমোদিত বইগুলো হলো: বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইসলাম ধর্ম, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়।

এর বাইরে স্কুলের সিলেবাসের বইগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সফোর্ড রিডিং সার্কেল, ইংলিশ হ্যান্ড রাইটিং বুক, অ্যাক্টিভ ইংলিশ বুক-২, অ্যাক্টিভ ইংলিশ ওয়ার্ক বুক, আনন্দ পাঠ, ড্রয়িংসহ আরও একটি।

ওই শিক্ষার্থীর বাবা জানান, প্রতিদিন সব বিষয়ের ক্লাস না হলেও ৫/৬টি ক্লাসে প্রত্যেক বইয়ের জন্য আলাদা খাতাসহ সব মিলিয়ে ব্যাগের ওজন হয় চার থেকে পাঁচ কেজি।

বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের বেঁটে হওয়ার কারণও অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা, বলেন এই অভিভাবক। অতিরিক্ত বইয়ের বিষয়ে স্কুলের প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি মিটিং করছেন বলে জানানো হয়। পরে নম্বর নিয়ে তার সেলফোনে ফোন করলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভার বহন করা উচিত নয়। এতে শিশুদের পিঠ ও পায়ে ব্যথাসহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

স্কুল ছুটির পর ওই স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায় দ্বিতীয় শ্রেণির আরেক ক্ষুদে শিক্ষার্থী বড় একটি ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে বাঁকা হয়ে দৌড়াচ্ছে একাই। সে জানায়, ‘সিলেবাসে ১২টি বই, প্রতি বিষয়ে আলাদা খাতা। ব্যাগ নিতে কষ্ট হয়’, এ কথা বলার পরই বাস ধরার জন্য দৌড় দেয় সেই ছাত্র।

মিরপুরে হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির একটি বইয়ের লিস্ট থেকে জানা যায়, বোর্ড অনুমোদিত তিনটি বইয়ের বাইরে তাদের রয়েছে ৬টি বই। এছাড়া খাতা, খাবার, পানির পট মিলে ব্যাগের ওজন হয় চার কেজির বেশি।

ওই স্কুলের একাধিক অভিভাবক বলেন, অতিরিক্ত ওজনে বাচ্চারা পিঠ, পায়ে ব্যথা অনুভব করেন। শিক্ষা আধুনিক হলেও এই বোঝা কমানো উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা।

মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় একাধিক কোচিং সেন্টারের সামনে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মনিপুর স্কুলসহ বেসরকারি বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে অতিরিক্ত বইয়ের কারণে প্রাইভেট-টিউশনির পাশাপাশি বাচ্চারা শারীরিকভাবে সমস্যায় ভুগছেন।

এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের আগস্ট মাসে হাইকোর্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে আইন প্রণয়নে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন।

মিরপুরের একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যক্ষ বাংলানিউজকে জানান, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার নামে ছোট বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। শিশুদের ওপর বই চাপিয়ে দিয়ে লাভ কী?

তিনি বলেন, ছোট বাচ্চারা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়বে, একাধিক বই পড়বে- এগুলো এখন স্ট্যাটাসের ব্যাপার। স্ট্যাটাস বাড়ানোর নামে শিশুদের হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
এমআইএইচ/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।